ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

ফরিদপুরের খলনায়ক বেয়াই মোশাররফ

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৪, ১২:৩১ এএম

ফরিদপুরের খলনায়ক বেয়াই মোশাররফ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

রাজাকারের সন্তান হলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘সাবেক’ বেয়াই হওয়ার সূত্রে ‘হেলমেট বাহিনী’ দিয়ে দেড় দশক স্বৈরাচার রাজার মতো ফরিদপুর শাসন করেছেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার মেয়ের শ্বশুর পরিচয়ে বৃহত্তর ফরিদপুরে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল বললেও রাজাকারপুত্র বেয়াই মোশাররফকে এমপি-মন্ত্রী বানান হাসিনা। তার ক্ষমতায় দুর্নীতি ও লুটপাটের বৈধ্যতা পান বেয়াই। ক্ষমতার শিখরে থেকে দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হন। বিদেশে অর্থ পাচার করে বাড়ি-গাড়ি ও কোম্পানি গড়েছেন, নিয়েছেন অন্য দেশের নাগরিকত্ব। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ফরিদপুরকে সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত করেন। অন্যের জমি দখল করে বাড়িবিলাসের নেশার আসক্তিতে পড়েন। প্রথমে শুধু বাড়িবিলাসের জন্য জমি দখল করলেও পরে তা পরিণত হয় নেশায়। দখলবাজি ও নানা অপকর্মের জন্য গড়ে তোলেন ‘স্পেলাশ সিন্ডিকেট’। মোশাররফের পরিবারের সদস্যরা ও ঘনিষ্টরা বিদেশে দুই হাজার কোটি টাকার পাচারের মামলায় অভিযুক্ত হয়ে কেউ জেলে, কেউ আত্মগোপনে। রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলের পর লাপাত্তা হয়ে গেছেন সেই মোশাররফ।

জানা যায়, ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মোশাররফ হোসেন হাসিনার সরকার আমলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা খাটিয়ে গড়ে তুলেছেন অঢেল সম্পদ। দেশে-বিদেশে পরিবার ও ঘনিষ্টজনদের নামে হাজার হাজার কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের সরকার আমলেই তার অনুসারীরা দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারে অভিযুক্ত। বহুল আলোচিত ২ হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় তাদের অনেকেই এখনো জেলে। দুর্নীতির এই মহোৎসবের কেন্দ্রে থেকেও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বেয়াই হওয়ার কারণে আইনের হাত থেকে বেঁচে যান খন্দকার মোশাররফ এবং দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেন বিদেশে মেয়ের কাছে। বর্তমানে সেখানেই বিলাসী জীবনযাপন করছেন। এর আগে ২০১৫ সালে সংঘ্যালঘুদের জমি দখলের অভিযোগে লোক দেখানো তদন্ত কমিটি করে হাসিনার সরকার।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে যাওয়ার পর সাবেক বেয়াই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের নানা অপকর্ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের খবর বেরিয়ে এলেও এখন বেরিয়ে আসছে দখলবাজ এক ভয়ংকর মোশাররফের কথা। ফরিদপুর তথা দেশের মানুষের কাছে বেয়াই মোশাররফ নামে পরিচিত। তার ক্ষমতার দাপটে তটস্ত থাকত ফরিদপুরের মানুষ। গত দেড় দশকে শুধু বাড়িবিলাশের জন্যই জমি দখল নেশায় পরিণত হয় মোশারফের। এ জন্য পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠতম আত্মীয়দের নিয়ে গড়ে তোলেন এক্সক্লুসিভ এক সিন্ডিকেট। যার নেতৃত্বে ছিলেন মোশাররফ নিজেই। ভুক্তভোগীরা এতদিন মুখ না খুললেও এখন  প্রকাশ্যে আসছে মোশাররফ বাহিনীর অপকর্ম।

রাজাকারের নাতি মোশাররফপুত্র খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ‘সাবেক’ স্বামী। গুঞ্জন রয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদের কিছুদিন আগে ঢাকাই চলচ্চিত্রের সুন্দরী এক নায়িকার সঙ্গে পরকীয়ার জেরে পুতুলের সঙ্গে মাশরুরের ডিভোর্স হয়। তারপর থেকেই মূলত নিরুদ্দেশ রয়েছেন মাশরুর। ওই সম্পর্কের টানাপোড়েনে খন্দকার মোশারফের পদ-পদবিতেও প্রভাব পড়ে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়। সরিয়ে দেওয়া হয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ থেকে। তখন থেকেই তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। শেখ পরিবারের ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এই খন্দকার পরিবারের বিরুদ্ধে।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। গত অক্টোবরে সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ পেয়েছে দুদক। সর্বশেষ গত ৩ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরে খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার ভাই সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

দখল ও বাড়িবিলাস: ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুর শহরের প্রবেশমুখে বদরপুরের বাড়িটির নাম ‘আফসানা মঞ্জিল’। আফসানা মঞ্জিলের পাশাপাশি বাংলো প্যাটার্নের তিনটি বাড়িজুড়ে বিশাল প্রশস্তের একটি বাসভবন গড়ে তোলা হয়েছে। বাড়ির সামনের উঠোনে সরকারি প্রটোকল আর গার্ড অব অনার নেওয়ার জন্য তৈরি পতাকার স্ট্যান্ড সম্বলিত বেদী করা হয়েছে। তারপর বড় দীঘি আকৃতির পুকুরের পরে একটি চিড়িয়াখানা! তার এক পাশে এই সমাধিসৌধ। সেই সমাধিসৌধে যদিও এ পর্যন্ত কাউকে সমাহিত করা হয়নি। উত্তর-পূর্বে গরুর খামার। আর তার পেছনে ফসলি ক্ষেত। প্রায় এক বর্গকিলোমিটারজুড়ে এই জৌলুসপূর্ণ বাড়ি এখন তার দম্ভের নীরব সাক্ষী। যা একসময় ছিল মাত্র দুই বিঘার মতো জমিজুড়ে। বাকি জমি তিনি জোর করে কব্জায় নেন বলে অভিযোগ।

আর দক্ষিণ কালিবাড়িতে পৈতৃক বাসভবনের পাশে গড়ে তোলা বাড়িটি ছিল ‘দয়াময় ভবন’। ওই সম্পত্তির মালিক ছিলেন অরুণ কুমার গুহ। সে সময়ে অরুণ গুহকে একপ্রকার অসহায়ত্বের মধ্যে ফেলে খুবই স্বল্পমূল্যে তিনি জমিটি কিনে নেন। সবমিলিয়ে ৩ একরেরও বেশি জমিতে গড়ে ওঠা বাংলোবাড়ির মূল্য বর্তমান বাজারে প্রায় ৮০ কোটি টাকার। যদিও খন্দকার মোশাররফ বাড়িটির কাজ শেষ করে ভবনে যেতে পারেননি। এককালের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী খন্দকার মোশাররফের বাংলো প্যাটার্নের তিনটি জৌলুসপূর্ণ বাড়ি রয়েছে ফরিদপুরে, যা এ অঞ্চলের সবচেয়ে বিলাসবহুল ও আকর্ষণীয়। এই তিনটি বাড়ির বর্তমান বাজার মূল্য একশ কোটি টাকারও বেশি। একসময় ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এই বাসভবনগুলো এখন খাঁ খাঁ এক বিরানভূমি।

শহরের বদরপুর, কমলাপুর ও ডিক্রিরচরে সরকারি খাস ও ব্যক্তিমালিকানার একের পর এক জায়গা-জমি দখল করে বিলাসবহুল আর নয়নাভিরাম এই তিনটি বাড়ি ছাড়াও খন্দকার মোশাররফের রয়েছে পৈতৃক ভিটার আরও দুটি বাড়ি। এ ছাড়া ঢাকার গুলশানেও তার বাড়ি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিলাসবহুল এ বাড়ি নির্মাণে খাসজমি, এমনকি সংখ্যালঘুদের জমিও দখল করেছেন খন্দকার মোশাররফ। এই বিপুল অর্থবৈভব আর প্রতিপত্তির মাঝেই দুর্নীতি আর দখলবাজির কেলেঙ্কারিতে ব্যাপক সমালোচিত হয়ে পতন হয় তার। আওয়ামী লীগের আমলে এসব দখল নিয়ে ভয়ে কেউ কথা না বললেও এখন অনেকে মুখ খুলছেন। জমি দখলের জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলেন খন্দকার মোশাররফ। এরা অতিশয় নিরীহ প্রতিবেশীদের ওপরে নির্মম নির্যাতন করে জোর করে জায়গা-জমি লিখে নিত। জমি মালিকদের অনবরত বাড়ি ছেড়ে দিতে দিনে-রাতে এসে হুমকি দিত। কখনো হামলা চালিয়ে বাড়িঘর এমনকি মানুষদের কুপিয়ে যেত। যারা লিখে দিতে চাইত না, তাদেরটা জোর করেই লিখে নিতেন তিনি। আবার না লিখে দিলে জোর করেই অন্যের জমি অবৈধভাবে দখল করে নিতেন হেলমেট বাহিনী। এই বিশেষ বাহিনীর একটি বড় ভূমিকা ছিল খন্দকার মোশাররফের বাড়ি তৈরির বিলাসিতা বাস্তবায়নে।

দুই হাজার কোটি পাচার মামলা: ২০২০ সালের ২৬ জুন ঢাকার কাফরুল থানায় খন্দকার মোশাররফের ভাই খন্দকার বাবরসহ মোশাররফ অনুসারীদের বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের একটি মামলা করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি। তার আগে ৬ জুন কথিত এক শুদ্ধি অভিযানে গ্রেপ্তার হন খন্দকার মোশাররফের একের পর এক আস্থাভাজনেরা। যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও অবৈধ টাকা উপার্জনের মূল অবলম্বন ছিলেন খন্দকার মোশাররফ। ওই মামলায় খন্দকার মোশাররফের ভাই বাবরকে মানি লন্ডারিংয়ের মাস্টার মাইন্ড হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিচারিক আদালত। ২০০৯ সালের মাঝামাঝি থেকে ফরিদপুরে ভাইয়ের ছায়া হিসেবে আবির্ভূত হন খন্দকার মোহতেশাম হোসেন। তিনি খন্দকার মোশাররফের অলিখিত প্রতিনিধি হিসেবে ফরিদপুরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। এ মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে খন্দকার মোশাররফসহ অনেকে গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন। হত্যাসহ অসংখ্য মামলায় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কারাগারে ঢোকানো হয়। মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় ছোট ভাই খন্দকার বাবরকে আসামি করা হয়। অবিশ্বাস্যভাবে আইনের জাল থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হন মোশাররফ।

ফরিদপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের টিকিটে সংসদ সদস্য হন। প্রথমবার শ্রমমন্ত্রী, পরেরবার প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী এবং সর্বশেষ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের অন্যতম ছিলেন আর ২০১৮ সালের রাতের ভোটের এমপি হন। এসব ব্যাপারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বা তার পরিবারের বক্তব্য জানতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ দেশে না থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি। যদিও মোশাররফের জামাতা সাবেক সংসদ সদস্য কায়েদ-ই-মিল্লাত ফরিদপুরের স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, ফরিদপুরে তাঁর শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এসব সম্পত্তির সব বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। কারও জায়গাজমি দখল করে নেননি তারা।

আরবি/জেডআর

Link copied!