জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদদের পরিবারকে অনুদান এবং আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরই মধ্যে উপদেষ্টা পরিষদে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিটি নিহত পরিবার পাবে ৩০ লাখ টাকা। আর আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব মুহাম্মদ নাজমুল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তা অনুমোদন দিয়েছেন। অপর এক চিঠি সূত্রে জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে অনুরোধ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অর্থ বিভাগ থেকে এই খাতের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আগামী সোমবার একটি সভা হবে। ওই সভায় সিদ্ধান্ত হবে কবে থেকে অর্থ দেওয়া শুরু হবে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, এখনই নিহতদের পরিবারকে দুই ভাগে টাকা দেওয়া হবে না। এর মধ্যে প্রথম ধাপে দেওয়া হবে ১০ লাখ টাকা সমপরিমাণ সঞ্চয়পত্র। আর দ্বিতীয় ধাপে বাকি ২০ লাখ টাকা দেওয়া হবে আগামী বাজেটে। এরপর জুলাইয়ের পর থেকে তা বণ্টন করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এর সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এই অর্থ বিতরণ করা হবে।
দুই উপদেষ্টার চিঠিতে বলা হয়েছিল, আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৬৩৭.৮০ কোটি টাকা ছাড় করতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে অনুরোধ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুজন উপদেষ্টা। এর মধ্যে ৩৯০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে আহতদের অনুদার দেওয়ার জন্য।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠির সূত্রে জানা গেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যেক শহিদ পরিবারকে পর্যায়ক্রমে ত্রিশ লাখ টাকা অনুদান এবং আহতদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে উপদেষ্টা পরিষদের নবম বৈঠকের ১৪.২ নম্বর সিদ্ধান্তে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনে গঠিত সেলের কার্যপরিধি সম্প্রসারণ করা হবে। এ ছাড়া উপদেষ্টা পরিষদের ষোড়শ বৈঠকের ১৩ নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ গঠিত না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ওই সেল জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারদের আর্থিক অনুদান এবং আহতদের পুনর্বাসনসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে নির্বাহ করবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ প্রতিষ্ঠার পর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের এই সেল জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তরকে সেলের সম্পদ ও দায়-দায়িত্ব হস্তান্তর করবে।
জানা গেছে, রুলস অব বিজনেস, ১৯৯৬-এর ২৩(৩) বিধি অনুসারে, এ সিদ্ধান্ত প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগকে জানাতে বলা হয়েছে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন, সিদ্ধান্তটি অবহিত হওয়ার পনেরো দিনের মধ্যে একবার এবং সিদ্ধান্তটির বাস্তবায়ন কার্য সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসের ৪ তারিখের মধ্যে একবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ অধিশাখায় পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
দুই উপদেষ্টা অর্থ উপদেষ্টকে দেওয়া চিঠিতে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ ব্যক্তিদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হওয়ার দেড় মাস পরও টাকা না দেওয়ায় জনমনে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ছে।
তারা আরও বলেছেন, এ অবস্থায় ওই শহিদ পরিবার ও আহতদের অনুদান দেওয়ার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণের জন্য প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও নিম্নস্বাক্ষরকারীগণের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গত ২৯ ডিসেম্বর (২০২৪ সালের) একটি সভায় মিলিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, খাতওয়ারি বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে লেখা এক চিঠিতে দ্রুত শহিদ পরিবারকে অনুদান দেওয়ার পাশাপাশি আহতদের অনুদান ও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে দ্রুত ৬৩৭.৮০ কোটি টাকা ছাড় করার অনুরোধ জানিয়েছেন ফাওজুল কবির খান ও মো. নাহিদ ইসলাম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের প্যাডে লেখা ওই চিঠিতে ফাওজুল কবির খানের সঙ্গে স্বাক্ষর করেছেন মো. নাহিদ ইসলাম, যার কপি রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে।
গত ১৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভা শেষে জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ুবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। ফাওজুল কবির খান ও মো. নাহিদ ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, জুলাই অভ্যুত্থানে ৮২৬ জন শহিদ হয়েছেন, যাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ৩০ লাখ টাকা হারে মোট ২৪৭.৮০ কোটি টাকা দিতে হবে।
এ ছাড়া, অভ্যুত্থানে ১৫০০০ আহতকে অনুদান বাবদ ২৯০ কোটি টাকা এবং দেশে-বিদেশে আহতদের চিকিৎসা বা কনসালটেন্সি বাবদ ১০০ কোটি টাকা ছাড় করার অনুরোধ করা হয়েছে।
আহতদের মধ্যে মারাত্মক আহত ১০০০ জনের প্রত্যেককে ৫ লাখ, ৩০০০ জনের প্রত্যেককে ৩ লাখ, ৪০০০ জনের প্রত্যেককে ২ লাখ এবং বাকি ৭০০০ জনের প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা হারে দেওয়ার অনুরোধ করেছেন ফাওজুল কবির ও নাহিদ ইসলাম।
গত ২১ ডিসেম্বর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহিদ ও আহত ব্যক্তিদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে গণঅভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল। প্রথম ধাপের খসড়া তালিকায় শহিদ ৮৫৮ জন এবং আহতের সংখ্যা ১১,৫৫১।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এই অর্থ বরাদ্দ করার জন্য অর্থ উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানিয়েছেন দুই উপদেষ্টা। অর্থ বরাদ্দের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শহিদ পরিবার ও আহতদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই বাবদ প্রাপ্য অর্থ সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হবে। শহিদ পরিবার ও আহতদের সহায়তা ব্যতীত অন্য কোনো কাজে এ অর্থ ব্যয় করা যাবে না।
আপনার মতামত লিখুন :