ঢাকা বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

সিআইডির সাবেক প্রধানের ক্যাশিয়ার এমরান বহাল তবিয়তে

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৪, ০১:১৬ এএম

সিআইডির সাবেক প্রধানের ক্যাশিয়ার এমরান বহাল তবিয়তে

এ কে এম এমরান ভুঞা। ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

*অবৈধভাবে শতকোটি টাকার মালিক
*আওয়ামী লীগের কর্মী পরিচয়ে ক্ষমতা জাহির
*তদন্তের নামে চাঁদাবাজি, মিথ্যা চার্জশিটের ভয় দেখানো
*মোহাম্মাদ আলী মিয়ার সিন্ডিকেটের ‘মিডিলম্যান’ ছিলেন


পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান স্বৈরাচার শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহচর অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ আলী মিয়ার ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত এ, কে এম এমরান ভুঞা। 

২৭ বিসিএস ব্যাচের এ, কে এম এমরান ভুঞা বর্তমানে সিআইডির ঢাকা মেট্রো (পশ্চিম) বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত। ক্ষমতার পালাবদলের পর নিজের অপরাধ আড়ালে রেখে ভোল পাল্টে এমরান ভুঞা এখনো বহাল তবিয়তে সরকারি দায়িত্ব পালন করছেন। অবৈধভাবে শতকোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া এমরান আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী পরিচয়ে ক্ষমতা জাহির করতেন। ভয়ে তটস্থ রাখতেন সিআইডির প্রধান কার্যালয়সহ পুরো সংস্থাটিকে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলা তদন্তের নামে চাঁদাবাজি এবং মিথ্যা চার্জশিটের ভয় দেখানোই ছিল এমরানের একমাত্র কাজ। সে সময়কার সিআইডি প্রধানের দুর্নীতিকে এগিয়ে নিতে আলাদা একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন তিনি, ছিলেন ‘মিডিলম্যান’। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অর্জিত টাকা থেকে কমিশন নিয়ে নিজে এবং পরিবারের নামে গড়ে তুলেছেন শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়।

অন্তর্বর্তী সরকার দুর্নীতিবাজ সাবেক সিআইড প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়াকে বাধ্যতামূলক অবসর পাঠানোর পর পুরোপুরি বদলে গেছেন পুলিশ কর্মকর্তা এমরান ভূঞা। অবৈধভাবে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে শত শত কোটি টাকা মালিক বনে যাওয়া সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার এমরান নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য আগের দেওয়া নিজের রাজনৈতিক পরিচয় লুকাতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন, বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তোষামোদ করছেন। ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট মোহাম্মদ আলী মিয়া সিআইডি প্রধান হওয়ার পর থেকেই এসএসপি এমরান তার বিশেষ সহকারী (স্টাফ অফিসার) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময় এমরান মোহাম্মাদ আলী মিয়ার সমস্ত দুর্নীতি এবং অপরাধের সহযোগী ছিলেন। পরিচিতি পান টাকা লেনদেনের ক্যাশিয়ার হিসেবে।

সূত্র মতে, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ঢাকা এবং নিজ জেলা নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অবৈধ্য সম্পদ গড়ে তুলেছেন। ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি, জমি, নগদ অর্থের মালিক এমরান ভূঞা স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে-বেনামে শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হলেও নিজের আয়কর বিবরণীতে এসব সম্পদের হিসাব দেননি। অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ লুকাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যদিও নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলছেন, সিনিয়রদের নির্দেশ মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। এতে ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকতে পারে। নিজের ভুলভ্রান্তি নিয়ে সহকর্মীদের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি। তবে শত শত কোটির টাকার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে এড়িয়ে যান তিনি।

জানা গেছে, বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডার ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী মিয়া ১৯৯৫ সালের ১৫ নভেম্বর পুলিশে যোগ দেন। তিনি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা। সিআইডি প্রধান হওয়ার আগে তিনি পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ডিআইজি, ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি, মানিকগঞ্জ ও হবিগঞ্জের জেলা পুলিশ সুপারসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্বে ছিলেন। এসব পদে থাকাকালীন মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগও কম ছিল না। তবে তৎকালীন সরকারের ‘ঘনিষ্ঠ’ কর্মকর্তা হিসেবে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আর সিআইডি প্রধান হিসেবে বসার পর ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করেন পুলিশের সাবেক এ কর্মকর্তা।

সূত্র মতে, মোহাম্মদ আলী মিয়া সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে নিজের ক্ষমতা বলয় সবসময় টিকিয়ে রাখতেন। প্রভাব খাটিয়ে সিআইডিতে তৈরি করেছিলেন নিজস্ব সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, নিজের সেই সিন্ডিকেটে কতিপয় অধস্তন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যুক্ত করেন। কয়েকশ ভুয়া অভিযোগ এনে তদন্ত করার নামে সিআইডির এই সাবেক প্রধান অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন। তার পাশাপাশি ক্যাশিয়ার এমরান গং কামিয়েছেন শত শত কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সাধারণ পুলিশ সদস্যদের হেনস্তার বিষয়টি মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে জানালেও মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মোহাম্মদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে ফ্যাসিষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় এমরান ভূঞাও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। সংস্থাটির প্রধানে বিশেষ সহকারী হওয়ায় তারই আনুকূল্য পেয়ে এবং অর্থ উপার্জনের অলিখিত ক্যাশিয়ার হয়ে চেইন অব কমান্ডকে ডিঙ্গিয়ে অপরাধ-দুর্নীতির আলাদা বলয় তৈরি করেছিলেন। নিজে হয়েছেন শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক।

গত এক সপ্তাহে সরেজমিনে সিআইডির মালিবাগ কার্যালয়ে একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাবেক প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়াকে গত ২২ আগস্ট বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনে চলমান ব্যাপক সংস্কারের মধ্যে দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তাকে সরাল অন্তর্বর্তী সরকার। সিআইডি প্রধান থাকাবস্থায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এরপরই ভোল পাল্টে ফেলেন দুর্নীতিবাজ এমরান ভূঞা। সুযোগমতো বদলি হন অন্য বিভাগে। ঢাকা মেট্রো (পশ্চিম ও স্টাফ অফিসার) মতো গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্টে সাবেক প্রধানের ক্যাশিয়ার হিসেবে আলোচিত এমরান ভূঞা কীভাবে পদায়ন হলেন সেই প্রশ্ন তুলেছেন বৈষম্যর শিকার হওয়া অন্য যৌগ্য কর্মকর্তারা।

সূত্র মতে, নরসিংদীর বাসিন্দা এ, কে, এম এমরান ভূঞা ২০০৮ সালে পুলিশে যোগদান করেন। চট্টগ্রাম রেঞ্জে কর্মরত থাকাকালীন তার বিরুদ্ধে ঘুষের একাধিক অভিযোগ ওঠে। সে সময় পুলিশ সদর দপ্তরে লিখিত অভিযোগও জমা পড়ে। নিজের রাজনৈতিক এবং অর্থের প্রভাব খাটিয়ে সেসব অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। পোস্টিং নেন সিআইডির প্রধান কার্যালয়ের মতো স্পর্শকাতর ডিপার্টমেন্টে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের শেষ সময়ে প্রমোশন পেয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে পুলিশ সুপার হন। বিসিএস ২৭ ব্যাচের যোগ্য অনেককে ডিঙ্গিয়ে তিনি সুপারনিউমারারি পদে এসপি (সংখ্যাতিরিক্ত পদ সৃষ্টি) হন।

আরবি/জেডআর

Link copied!