চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের নাকের ডগায় নকল সিগারেটের রমরমা ব্যবসা করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তারা গ্রুপ। আর তারা গ্রুপের অবৈধ ব্যবসার সুবিধাভোগী ছিলেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ও বিজয় টোব্যাকোর মালিক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। টোব্যাকো সংক্রান্ত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উচ্চ পর্যায়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। তারা গ্রুপের লিটনের ব্যাংক হিসাবে সিগারেট বিক্রির প্রায় ৮০২ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য পেয়েছে। লিটনের তারা গ্রুপের তৈরি বিদেশি অরিস ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট উৎপাদন করে বাজারজাত করারও প্রমাণ পেয়েছে এনবিআরের গঠিত তদন্ত কমিটি। তারা গ্রুপের মালিক লিটন ও তার পরিবারের আয়কর নথি অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে এনবিআরের গঠিত তদন্ত কমিটি। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, তারা গ্রুপ ঢাকার র্যাপিড মার্কেটিং, মুন এন্টারপ্রাইজ ও বেঙ্গল লিফ নামের এই তিন কোম্পানির মাধ্যমে সিগারেটের উপকরণ আমদানি করতেন। আর এই উপকরণ র্যাপিড প্যাকেজিং নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রহণ করেছে তারা টোব্যাকো। এ ছাড়াও অস্তিত্বহীন কিছু প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকার সিগারেটের উপকরণ আমদানি করে তারা টোব্যাকো সরবরাহ করেছে। এই জালিয়াতিতে রয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের প্রতিষ্ঠান বিজয় টোব্যাকো। প্রতিষ্ঠানগুলো চট্টগ্রামভিত্তিক দুটি কারখানায় বিদেশি অরিস ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট তৈরি করে বাজারজাত করেছে। এই সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় ডজনখানেক নামসর্বস্ব কোম্পানি। এসব কোম্পানির অনিয়ম বন্ধে এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ১৯টি প্রতিষ্ঠানের আমদানি ও সরবরাহের তথ্য অনুসন্ধান করে এই প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ১১০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে দেশে নকল সিগারেট তৈরির বিভিন্ন বিষয় অনুসন্ধান করেছে। একইসঙ্গে নাম-ঠিকানাবিহীন প্রতিষ্ঠানের আমদানি তথ্যও পেয়েছে। বন্ধ রয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে এখনো টাকা জমা হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা গ্রুপের সঙ্গে প্রায় পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের সরাসরি সম্পৃক্ততা পেয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান সিগারেটের উপকরণ আমদানি করে বিজয় ও তারা টোব্যাকোকে সরবরাহ করেছে। এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় সিনথেটিক আমদানির আড়ালে সিগারেটের উপকরণ আমদানির প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।
সূত্র আরও জানায়, তারা গ্রুপের মালিক আব্দুস সবুর লিটনের কর্মচারী শহীদুল আলমের নামে আলম টেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েন। মূলত এই প্রতিষ্ঠানের শহীদুল আলম বিভিন্ন সময়ে তারা গ্রুপের অর্থ জমা ও উত্তোলনের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এই শহীদুল আলমই আলম ট্রেডার্সের মাধ্যমে তারা গ্রুপের ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা করতেন। নকল এই সিগারেট তৈরি ও বাজারজাতের আরও দুটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান একে এন্টারপ্রাইজ ও আফসার অ্যান্ড ব্রার্দাস।
প্রতিষ্ঠানগুলো তারা ট্রেড লিংক কোম্পানির হিসাবে অর্থ জমা করেছে। এ ছাড়া সিগারেট তৈরির উপকরণও সরবরাহ করেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের (সিআইসি) ডেপুটি কমিশনার নুরুল বশির বলেন, ‘বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নকল সিগারেট তৈরি এবং নকল ব্যান্ড রোল লাগিয়ে সরবরাহ করার অভিযোগ ওঠার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি এখন কাজ করছে।’ ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর থেকে পলাতক সাবেক মন্ত্রী নওফেল এবং প্যানেল মেয়র লিটন। তাঁদের মোবাইলও রয়েছে বন্ধ। তাই অভিযোগের বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে নকল সিগারেট তৈরি এবং নকল ব্যান্ড রোল লাগিয়ে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট তৈরির নেতৃত্বে রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আবদুস সবুর লিটনের মালিকানাধীন দুই প্রতিষ্ঠান বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো। যার ই-টিআইএন নাম্বার-২৭৮২১৮৬৫৯৫৮৫, বিআইএন নাম্বার-০০২৫৬৮৯০২-০৫০৭ এবং ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর ই-টিআইএন নাম্বার-২৬৭৬৩৩৭০৪৬২১ ও বিআইএন নাম্বার-০০০১৩৩৩০১-০৩০৬। এর মধ্যে একটি কোম্পানির ৪০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের।
অভিযোগ রয়েছে, বিজয় এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সিগারেট তৈরির কাঁচামাল-অ্যাসিটেট টো, পরিশোধিত তামাক ও সিগারেট মোড়ানোর জন্য কাগজ সংগ্রহ করে। পরে কক্সবাজারের চকরিয়া এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিবপুরের কারখানায় নকল সিগারেট তৈরি করে। তাদের কারখানায় তৈরি হওয়া বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটে লাগানো হয় নকল ব্যান্ড রোল। নকল এ সিগারেট দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো প্রতিষ্ঠার পর থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার টন সিগারেট তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করেছে সিগারেটের কাঁচামাল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে; যা দিয়ে পাঁচ কোটি সিগারেটের শলাকা তৈরি সম্ভব।
এখানে সরকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ রাজস্ব হারিয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া লিটন সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তামাক কোম্পানির সিগারেটের শলাকায় ব্যবহার করা ব্যান্ড রোল সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা পানের দোকান থেকে সিগারেট কোম্পানির ব্যবহার করা ব্যান্ড রোল সংগ্রহ করেন। এজন্য প্রতি কেজিতে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হয় দোকানদারকে। পুরোনো ব্যান্ড রোল বারবার ব্যবহার করে এ সিন্ডিকেট ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ লোপট করেছে কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট ও ব্যান্ড রোল জালিয়াতি করে দুই প্রতিষ্ঠান লোপাট করেছে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তারা গ্রুপের লিটনের ব্যাংক হিসাবে সিগারেট বিক্রির প্রায় ৮০২ কোটি টাকা জমা হওয়ার তথ্য পেয়েছে টোব্যাকো সংক্রান্ত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উচ্চ পর্যায়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিটি। লিটনের তারা গ্রুপের তৈরি বিদেশি অরিস ব্র্যান্ডের নকল সিগারেট উৎপাদন করে বাজারজাত করারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা গ্রুপের মালিক লিটন ও তার পরিবারের আয়কর নথি অনুসন্ধানের সুপারিশ করেছে এনবিআরের গঠিত তদন্ত কমিটি।
রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বিজয় ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা হয়। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন চসিকের সাবেক প্যানেল মেয়র ও নওফেলঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আবদুস সবুর লিটন।
কোম্পানিতে শেয়ারের সংখ্যা ১০ হাজার। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে রয়েছেন লিটনের ভাই আবদুল মান্নান খোকন। তাঁর শেয়ারের সংখ্যা ২ হাজার। ওই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হিসেবে রয়েছে নিহান ইনভেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের প্রতিনিধি এমা ক্লেয়ার বার্টন। ওখানে দেওয়া তথ্যে, এমার স্বামী হিসেবে মহিবুল হাসান চৌধুরীর নাম দেওয়া হয়েছে। ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে ২০৭ চশমা হিল আবাসিক এলাকা, খুলশী, চট্টগ্রাম; যা মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পৈতৃক নিবাস। সূত্র বলছে, নিহান ইনভেস্ট হোল্ডিং লিমিটেডের ৯৯ শতাংশ শেয়ার হচ্ছে নওফেল ও তাঁর স্ত্রী এমার। বাকি এক শতাংশ তাদের এক পারিবারিক বন্ধুর।
জানা যায়, বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নকল সিগারেট তৈরি এবং নকল ব্যান্ড রোল কারখানার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে বারবার অভিযান পরিচালনা করেছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু প্রতিবারই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকেছে দুই প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ ২৫ সেপ্টেম্বর তারা ইন্টারন্যাশনালের কারখানায় যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে ৫৩ হাজার অবৈধ রাজস্ব স্ট্যাম্প এবং ১৩ লাখ ১৯ হাজার ৮২০ শলাকা সিগারেট জব্দ করা হয়। পরে নকল সিগারেট উৎপাদনের অভিযোগে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো কোম্পানিকে ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে ৯ মে শুল্ক গোয়েন্দা তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোতে অভিযান চালায়। গত ২১ মে শুল্ক গোয়েন্দারা কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় বিজয় ইন্টারন্যাশনালের কার্যালয়ে অভিযান চালান। সেখানে নকল সিগারেট তৈরির মালামাল জব্দ করা হয়। বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো এবং তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর নকল সিগারেট ও নকল ব্যান্ড রোল লাগিয়ে সিগারেট সরবরাহের অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে চট্টগ্রাম সিআইডি।
আপনার মতামত লিখুন :