পুরোনো রীতি অনুযায়ী বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হতো প্রায় সব বই। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে এবার ঘটেছে ব্যত্যয়। নতুন শিক্ষাবর্ষের ২৩ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেনি তিন-চারটির বেশি বই। সব বই না পাওয়া স্কুলে স্কুলে হচ্ছে না ঠিকমতো পাঠদান। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই যাচ্ছে না ক্লাসে। এমন সংকটময় সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যখন ‘লাটে উঠেছে’ ঠিক সেই সময় বিনা মূল্যের পাঠ্যবই খোলাবাজারে বেশি দরে বিক্রিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে একটি চক্র। ইতোমধ্যে সারা দেশের খোলাবাজার ছেয়ে গেছে বিনা মূল্যের পাঠ্যবইয়ে। বিভিন্ন জায়গায় দেদার বিক্রি হচ্ছে বই। তবে এই কালোবাজারে বই বিক্রি বন্ধ ও সংশ্লিষ্ট চক্রকে গ্রেপ্তার করতে সক্রিয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবারও পুরান ঢাকার বাংলাবাজার থেকে ১০ হাজার বইসহ দুজনকে এবং শেরপুর থেকে ৯ হাজার পাঠ্যবই জব্দসহ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।
তথ্যমতে, গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার রৌমারী সি জি জামান উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ট্রাকে বোঝাই করে বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া প্রায় ৯ হাজার বই শেরপুর জেলার সদর উপজেলা থেকে আটক করেছে পুুলিশ। এ ঘটনায় মাহিদুল ইসলাম (৩২) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক মাহিদুলের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলায়। এই বইগুলো ২০২৫ সালের অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ের বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শেরপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, জব্দ করা বইগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। একটি চক্র বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের গুরুতর অপরাধমূলক কাজ করেছে। এ চক্রের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের শনাক্ত করার জন্য পুলিশ অনুসন্ধান করে দেখছে।
এর আগে গত বুধবার রাতে পুরান ঢাকার বাংলাবাজারের ইস্পাহানি গলি থেকে প্রায় ১০ হাজার বইসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ইস্পাহানি গলির বিভিন্ন গুদামে অভিযান চালিয়ে জব্দ করা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের এসব বইয়ের বাজারমূল্য প্রায় আট লাখ টাকা। গ্রেপ্তার ৫৫ বয়সি সিরাজুল ইসলাম উজ্জ্বল ও ৫৬ বছর বয়সি দেলোয়ার হোসেনের বাইরেও এমন আরও বেশ কয়েকটি চক্রের তথ্য পাওয়া গেছে। এর পেছনে মূলত কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখে তাদের গ্রেপ্তারে ডিবির তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এসব তথ্য জানিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, একটি চক্র বাংলাবাজারের ইস্পাহানি গলিতে বিভিন্ন গোডাউনে প্রথম থেকে দশম শ্রেণির বিনা মূল্যে বিতরণের সরকারি পাঠ্যবই বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে মজুত করেছে- এমন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে দুই ট্রাক বই জব্দ করা হয়। যেখানে বিভিন্ন শ্রেণির প্রায় ১০ হাজার বই রয়েছে। জব্দ করা বইগুলোর বিষয়ে আদালতকে অবগত করা হবে, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এনসিটিবিকে হস্তান্তরের কথাও জানান ডিবির এই কর্মকর্তা।
এনসিটিবি অথবা মাউশির কেউ জড়িত রয়েছে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে ডিবির যুগ্ম কমিশনার নাসিরুল বলেন, এনসিটিবির দুইটা গোডাউন রয়েছে একটা তেজগাঁও ও আরেকটা টঙ্গীতে। সেখানেই বইগুলো সংরক্ষণ করা হয়, এর বাইরে কোথাও সংরক্ষণের সুযোগ নেই। ভেতরের কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গ্রেপ্তার সিরাজুল ইসলাম উজ্জল ১০ বছর আগে একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জানিয়ে ডিবির এই কর্মকর্তা বলেন, এবার তার গোডাউন থেকেই বইগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি ১০-১২ টাকা করে বইগুলো কিনে ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি করে আসছিলেন। বিতরণ এবং পরিবহনের অনিয়মে কার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এমন আরও কিছু নাম আমরা পেয়েছি। সে অনুযায়ী ব্যবস্থ্ ানেওয়া হবে।
এ ছাড়াও গত সোমবার বাংলাবাজারে অভিযান পরিচালনা করে পাঁচ হাজার বই উদ্ধার করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় দুটি দোকানকে জরিমানা করা হয়েছে।
ভ্রাম্যমাণ আদালত সূত্রে জানা গেছে, অভিযান পরিচালনাকালে বাংলাবাজার বই মার্কেটের দুটি দোকান ও একটি গোডাউনে বিভিন্ন প্রেসে ছাপা বই উদ্ধার করা হয়। সরকার প্রিন্টার্স, লেটার অ্যান্ড কালার লিমিটেড, সীমান্ত প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন মাস্টার সিমেক্স ও সুবর্ণা প্রিন্টিং প্রেসে মুদ্রণ করা মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই জব্দ করা হয়। এসব বই ‘বই বাজার বিডি’ ও ‘জাহিদ বুক হাউজ’ লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। এদের প্রতিটিকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয় এবং ভবিষ্যতে একই অপরাধ করলে সর্বোচ্চ জরিমানা ও জেল দেওয়া হবে মর্মে সতর্ক করা হয়। এর বাইরে রাজধারীর নীলক্ষেতের বিভিন্ন বইয়ের দোকানেও অভিযান চালিয়ে বই উদ্ধার ও বিক্রেতাদের জরিমানা করা হয়।
এ প্রসঙ্গে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, এটা অসৎ প্রিন্টারদের কাজ। ইতোমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা হানা দিচ্ছে। শাস্তির আওতায় আনা হবে দোষীদের।
পাঠ্যবই ছাপার সর্বশেষ অবস্থা: এনসিটিবি সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এবার প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২টি বই। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত ছাপা শেষে বিদ্যালয়ে পাঠানোর জন্য তৈরি প্রায় ১৩ কোটির মতো বই।
রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত প্রি-প্রাইমারির বই পায়নি শিক্ষার্থীরা। বছর শুরুর দিন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব বই শিক্ষার্থীরা পেয়েছে। আর ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চতুর্থ শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ চারটি বই পেয়েছে। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ ছয়টি বই পেয়েছে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিত এবং দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাংলা, ইংরেজি ও গণিতসহ ছয়টি বই পেয়েছে। এ ছাড়া অন্য ক্লাসের কিছু বই পেয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। কবে নাগাদ বাকি বই পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।
পাঠ্যবই কবে নাগাদ দেওয়া সম্ভব হবে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ২৫ জানুয়ারির মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির বই যাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দশম শ্রেণির সব বই চলে যাবে ২৭-২৮ জানুয়ারির মধ্যে। তাহলে তো ৫০ শতাংশ বই চলে গেল। বাকি বইগুলো পরবর্তী ১৫-২০ দিনের মধ্যে চলে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :