ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪

যানজট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার

রুবেল রহমান

প্রকাশিত: অক্টোবর ১৮, ২০২৪, ১০:২০ এএম

যানজট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সরকার

ফাইল ছবি

►লো কস্ট নো কস্ট নীতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ
►সেমি অটোমেটিক ফ্ল্যাক্সিবল সিগন্যাল কার্যকর
►দেশীয় প্রযুক্তির এই প্রকল্পে থাকছে না বড় কোনো বাজেট
►ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা দূর করা জরুরি
►তিন চাকার যান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে

তিলোত্তমা ঢাকার যানজট কমাতে সেমি অটোমেটিক ফ্ল্যাক্সিবল সিগন্যাল কার্যকর করতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রেসক্লাব-হাইকোর্ট এলাকা থেকে শুরু করে উত্তরার অবদুল্লাহপুর পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনার কথা জানান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় বুয়েটের অধ্যাপক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান। দেশীয় প্রযুক্তিতে এই প্রকল্পে থাকছে না বড় কোনো বাজেট। লো কস্ট নো কস্ট নীতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

হাসিনা সরকারের পতনের পর মানুষ অবাধ স্বাধীনতা উদ্্যাপন করলেও নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে সময়মতো কাজ যোগ দেয়নি পুলিশ। দেরিতে যোগ দিলেও ট্রাফিক পুলিশের উদাসীনতায় ভেঙে পড়েছে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা। প্রধান সড়কে মোটরযানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে রিকশা ও অটোরিকশা। ফলে মূল সড়কে বেড়েছে যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে বসে বিরক্ত যাত্রীরা। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। রাজধানীর প্রধান সড়কে চোখ রাখলেই দেখা মিলবে ব্যাটারিচালিত অবৈধ্য এসব যানবাহনের।  এতে যেমন বেড়েছে যানজট, তেমনি বেড়েছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। কারওয়ান বাজার চৌরাস্তায় মূল সড়কের ওপরে বসে আছেন মোটরসাইকেল রাইডার। যেন দেখার কেউ নেই। পুলিশের ভয় নেই। বুক টান করে যাত্রী ডাকছেন। কথা হয় এমন কয়েকজন বাইক রাইডারের সঙ্গে। ইসরাফিল নামের এক রাইডার বলেন, ‘রাস্তার মাঝখানে রাখলে সমস্যা নেই। দেশ স্বাধীন, পুলিশ কিছু বলছে না, আপনার সমস্যা কোথায়?’ সড়কে যানজট তৈরি করছেন কেন জানতে চাইলে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তর্কে জড়ান তিনি। বলেন, ‘দেশে কত বড় বড় অপরাধ হয়, সেদিকে খেয়াল আছে? আমি পেটের দায়ে বাইক নিয়ে নেমেছি।’ আরেক রাইডার সুমন নিজের ভুল বুজতে পেরে বলেন, ‘কেউ কিছু বলে না, তাই রেখেছি। আচ্ছা, আমি সরিয়ে নিচ্ছি।’

বাংলামোটর এলাকায় কথা হয় পথচারী মকবুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, ট্রাফিক পুলিশ এখন ঠিকমতো কাজ করছে না। কারণ তারা এখন সড়কে হাত পেতে টাকা নিতে পারে না। উপরি ইনকাম না থাকায় তারা এখন দায়সারা ডিউটি করে। তারা এমন আচরণ করছে কেন? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। শাকিলা লাকি নামের এক যাত্রী জানান, ৫ আগস্টের পর সড়কে এখন জ্যাম এত বেশি বেড়েছে, এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। সময়মতো অফিসে যেত পারি না। প্রায় প্রতিদিনই এই বিড়ম্বনায় পড়ি। বিরক্ত লাগে। সরকার যেন এদিকে একটু সুনজর দেয়।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জান মনে করেন, অতীতে প্রকল্পভিত্তিক সমাধানের পথে হেঁটে শত শত কোটি টাকা গচ্চা গেলেও যানজট সমস্যার সমাধান হয়নি। তাই স্বল্প মেয়াদে সমস্যা সমাধানে দৃশ্যমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে বলে জানান এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে ট্রাফিক সিস্টেম আমদানি না করে দেশীয় ব্যবস্থাপনায় সমাধানের পথ খুঁজছে সরকার। প্রস্তুতি চূড়ান্ত জানিয়ে শিগগিরই তা বাস্তবায়ন করার কথা জানান তিনি। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, অর্থের অপচয় না করে দেশীয় প্রযুক্তিতে সঠিক ব্যবস্থাপনায় সংকটের সমাধান সম্ভব। সড়কের যে পথ আমরা আগে এক ঘণ্টায় পাড়ি দিতে পারতাম, সেটা এখন পাড়ি দিতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা কিংবা আরও বেশি। কারণ ট্রাফিক সিস্টেম পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তাৎক্ষণিক পরিবর্তন আনা যায় কি না, সেই লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা একটি কমিটি করে দিয়েছেন আমাদের, যার অঙ্গীকার হচ্ছে ‘লো কস্ট নো কস্ট সমাধান’। মূলত স্বল্প ব্যয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছি আমরা। অতীতে দেখেছি, প্রকল্পভিত্তিক সমাধানের পথে হেঁটেছে সরকার, সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেনি তারা। সমস্যাভিত্তিক সমাধানের পথে তারা হাঁটেনি, কারণ সেখানে বাজেট থাকে না, তাই ম্যানেজমেন্টও করতে চায়নি নগর কর্তৃপক্ষ। শুধু প্রকল্পভিত্তিক কাজের দিকেই ঝুঁকেছিল। ফলে ব্যয় হয়েছে, সমাধান হয়নি।

হাদিউজ্জামান বলেন, আমরা স্বল্প মেয়াদে সমস্যা সমাধানের চিন্তা করছি। ৫ আগস্টের পর ঢাকার বাইরে থেকে ৬-৭ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা প্রবেশ করেছে ঢাকার সড়কে। দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, নতুন করে তখন স্বাধীনতা উপভোগ করতে গিয়েই এরকম সমন্বয়হীনতা। কারণ ৫ আগস্টের পর পুলিশ ছিল না সড়কে। নিরাপত্তার অজুহাতে তারা কাজে যোগ দিয়েছে দীর্ঘ সময় পর। সেই সুযোগে রাজপথ দখল করে নিয়েছে রিকশা ও অটোরিকশাগুলো। প্রধান সড়কের রিকশা ও অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার খুবই দ্রুত। যে রিকশা অবৈধ, চালক অবৈধ, তারা বৈধ সড়কে চলে কী করে? সড়কের যে ব্যাকরণ রয়েছে, তারা সেই ব্যাকরণ পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। ট্রাফিক আইন সম্বন্ধে তাদের কোনো ধারণাই নেই। বড় বড় বাসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে তারা। যানজট থেকে বাঁচতে এখনই বন্ধ করা উচিত এসব রিকশা আমদানি অথবা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত চার্জিং স্টেশনগুলোও। অবৈধ্য বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে এসব অটোরিকশায় চার্জ দেওয়া হয়। ফলে বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ছে।

সড়কে যানজট নিয়ন্ত্রণে প্রথমে চৌরাস্তাগুলো ফাংশনাল করতে হবে। তার জন্য একটি পরিকল্পনার প্রয়োজন। ইলিগ্যাল পার্কিং বন্ধ করতে হবে আগে। যত্রতত্র বাস থামানো চলবে না। নির্ধারিত স্থানেই বাস থামাতে হবে। পাশাপাশি বাস থামানো বন্ধ করতে হবে। সারিবদ্ধভাবে বাস থামানো এবং নির্ধারিত স্টপেজে যাত্রী তোলা ও নামানো যাবে। এই নিয়ন্ত্রণটা করতে পারলেও ৬০ শতাংশ যানজট কমে যাবে। ট্রাফিক ঠিকমতো কাজ করছে না এটা ঠিক। বর্তমানে দীর্ঘ সময় সবুজ বাতি দিয়ে রাখে, ফলে পরবর্তী জংশনে ট্রাফিক জ্যাম আবার সৃষ্টি হয়। ছোট জংশনগুলোতে সর্বোচ্চ দুই মিনিট সাইকেল টাইম দেওয়া যেতে পারে, বড় জংশনে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট ট্রাফিক জ্যাম দিয়ে রাখতে পারে। সিগন্যালে ট্রাফিক জ্যাম অতিমাত্রায় হওয়ার পর ট্রাফিক পুলিশ একসময় বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেন। তিনি পরিশ্রান্ত হয়ে যান, ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ফলে ট্রাফিক সিস্টেম আর কাজ করে না। দেশীয় প্রযুক্তিতে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন করতে পারলে সংকটের সমাধান অনেকটাই সম্ভব। টেকসই উন্নয়নের পথে হাঁটতে চাই আমরা। অতীতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করেও সিগন্যাল ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে আগের সরকার। কাজের কাজ কিছুই হয়নি, মাঝখান থেকে ২৫০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।

গুলশানে একটি সিগন্যাল ছাড়া এর কার্যকারিতা নেই কোথাও।  ট্র্যাফিক সিস্টেম দেশীয় প্রযুক্তিতে হলে আমরা এর রোগ সহজেই ধরতে পারব। এর ফেব্রিকেশন থাকবে আমাদের হাতে। কোনো যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে দ্রুত রিপ্লেস করতে পারব। কারণ ট্রাফিকিং চলে দিনে ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাত দিন, বছরে ৩৬৫ দিন। যেহেতু ট্রাফিকিং সিস্টেম বন্ধ রাখার সুযোগ নেই, সেহেতু দ্রুত সমস্যার সমাধান করতে হয়। বিদেশ থেকে আমদানি করলে একটি যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। এই মালামাল বিদেশে থেকে আনতে সময় লাগবে ৮ থেকে ১০ মাস। ততদিন কি বন্ধ থাকবে ট্রাফিক সিস্টেম? এটা টেকসই উন্নয়ন নয়। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন দেশীয় প্রযুক্তিতে বানাতে। পরীক্ষামূলক চালানোর জন্য ইতিমধ্যে আমরা ট্রাফিক লাইট সিস্টেম ডেভেলপ করে ফেলেছি। ডুয়েল মুড থাকবে এই ট্রাফিকিং সিগন্যালে। অটোমেটিক ও মেনুয়াল দুই সিস্টেমই থাকবে। এর নাম দিয়েছি আমরা সেমি অটোমেটিক ফ্ল্যাক্সিবল সিগন্যাল সিস্টেম। হাতের ইশারায় একবিংশ শতাব্দীতে ট্রাফিক সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ বড়ই বেমানান। আমরা চাইছি লাইটিংয়ের মাধ্যমেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে।

হাইকোর্ট, কাকরাইল, ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সোনারগাঁও মোড় বা কারওয়ান বাজার হয়ে ফার্মগেট, মহাখালী দিয়ে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত আমরা এই প্রকল্প প্রথম বাস্তবায়ন করতে চাই। এই পথে ২২টি ইন্টারসেকশন আছে। আশা করছি এই সিস্টেম ডেভেলাপ করতে পারলে যানজট অনেকটাই কমে যাবে। সোনারগাঁও মোড়ে আগামী এক মাসের মধ্যে আমরা পাইলটিং প্রকল্প চালু করব। আমরা প্রাইমারিভাবে একটি ট্রাফিক সিস্টেম ডেভেলপ করেছি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে। শিগগিরই সবার সামনে নিয়ে আসবে আমাদের বুয়েটের টিম।

আরবি/জেআই

Link copied!