ঢাকা শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪
‘বেয়াদব-হ্যাডম ওমর’ হিসেবে পরিচিত

‘হ্যাডমওয়ালা’ শাহজাহান ওমরকে গণপিটুনি, গাড়ি-বাড়ি ভাঙচুর

শাহীন করিম ও হাসিবুল ইসলাম

প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৪, ০৯:৪০ পিএম

‘হ্যাডমওয়ালা’ শাহজাহান ওমরকে গণপিটুনি, গাড়ি-বাড়ি ভাঙচুর

ছবি : রূপালী বাংলাদেশ

একসময় ঝালকাঠি জেলা বিএনপির রাজনীতিতে মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন তিনি। ৪৫ বছর ধরে চালান একক রাজত্ব। একাধিকবার জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। ছিলেন প্রতিমন্ত্রীও। তার দাপটে তটস্থ থাকতেন নিজ দলের নেতাকর্মীসহ বিরোধী শিবির। জেলার সরকারি কর্মকর্তা ও দলের সিনিয়র নেতাদের সবার সামনে অপমান করতেন। দিতেন অকথ্য ভাষায় গালাগাল। মুখের ভাষা চরম খারাপ, কাউকে করতেন না সম্মান। সর্বত্র দেখাতেন ক্ষমতার দাপট তথা হ্যাডম। তাই জেলার মুরব্বিরা আড়ালে তাকে ডাকেন ‘বেয়াদব ও হ্যাডম ওমর’। বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে আচমকা পল্টি মেরে নিজ দল বিএনপি ছেড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে মনোনয়ন নেন। সেই সময় নানা দম্ভোক্তি, বেফাঁস মন্তব্য ও আচরণে সারা দেশে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হন তিনি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে যান। স্থানীয় ও জাতীয় রাজনীতিতে তিনি পল্টিবাজ রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পান।

তিনি হচ্ছেন ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম)। অবশেষে গতকাল বৃহস্পতিবার নিজ থানা রাজাপুরে গ্রেপ্তার হন তিনি। এর আগে খেয়েছেন গণপিটুনি, ভাঙচুর করা হয়েছে তার গাড়ি-বাড়ি। তার গ্রেপ্তারের খবরে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ তাদের নেতার অতীত সম্পর্কে এমন তথ্য জানান ঝালকাঠির বাসিন্দারা। বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া বিতর্কিত রাজনীতিবিদ শাহজাহান ওমরকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। কাঁঠালিয়ার বাসস্ট্যান্ডে উপজেলা বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় হওয়া মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুপুরে ঝালকাঠির আদালত প্রাঙ্গণে নেওয়া হলে বিএনপির নেতাকর্মীরা ওমরের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাকে লক্ষ্য করে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করেন ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। এ সময় বেফাঁস মন্তব্য করে শাহজাহান ওমর বলেন, ‘আমি আবারও এমপি-মন্ত্রী হব, লিখে রাখেন।’ এর আগে সকালে গাড়ি ভাঙচুর করে ওমরকে লাঞ্চিত করেন বিক্ষুব্ধ জনতা। সেই ঘটনার পর রাজাপুর থানায় আশ্রয় নেন তিনি। সেখান থেকেই গ্রেপ্তার হন ‘হ্যাডম ওমর’। এর আগে বুধবার রাতে তার গ্রামের বাড়িতে ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা।

যেভাবে গ্রেপ্তার হন শাহজাহান ওমর : বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের গাড়িতে বৃহস্পতিবার নিজ এলাকা রাজাপুরে সকাল ৯টার দিকে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা করতে যান তিনি। পরে অন্য একটি মামলায় তাকেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের আগে শাহজাহান ওমর ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর থানার সামনে সাংবাদিকের কাছে অভিযোগ করেন, ‘সকালে বরিশালের বাসা থেকে রাজাপুরে আসার পথে উত্তর পিংড়ী বাড়ইবাড়ী এলাকায় আমার গাড়িতে হামলা চালায় উপজেলা বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এর আগে বুধবার রাতে রাজাপুর উপজেলা সদরের গোডাউন ঘাট এলাকায় আমার বাড়ি মাহজাবীনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়।’

জানা যায়, বৃহস্পতিবার তিনি রাজাপুর যাচ্ছেন এমন আগাম খবরে বুধবার সন্ধ্যায় রাজাপুর উপজেলা বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিল থেকে একটি গ্রুপ পৃথক হয়ে উপজেলা সদরে শাহজাহান ওমরের বাসভবনে হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ। এ সময় ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে জানালার গ্লাস ভাঙচুর করা হয়। গতকাল সকাল ৯টার দিকে রাজাপুরে প্রবেশ করতে চাইলে উপজেলারর সীমান্ত বাড়ইবাড়ী এলাকা অতিক্রম করে উত্তর পিংড়ি এলাকায় পৌঁছালে তার গাড়িতে হামলা করে দুর্বৃত্তরা। এতে তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। তিনিও আহত হন। আহতাবস্থায় গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রান্তিক পথ ঘুরে সাংগর গ্রামের বাড়িতে অবস্থান নেন। কিছুক্ষণ পর সাড়ে ১০টার দিকে রাজাপুর থানায় গাড়ি ভাঙচুরের মামলা দিতে গেলে উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা বাইরে থেকে থানা ঘেরাও করে অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে কাঠালিয়া থানায় করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুহিতুল ইসলাম জানান, সাবেক এমপি ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার নামে কাঠালিয়ায় একটি নিয়মিত মামলা রয়েছে।

আদালত চত্বরে ওমরকে জুতা-ডিম নিক্ষেপ : ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঠালিয়া) আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক আলোচিত সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মুহাম্মদ শাহজাহান ওমরকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গতকাল দুপুরে ঝালকাঠির আদালত প্রাঙ্গণে আনা হলে বিএনপির নেতাকর্মীরা শাহজাহান ওমরের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। তাকে লক্ষ্য করে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করেন ক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা।

জেলা বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘শাহজাহান ওমর বিএনপি ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। মীরজাফর শাহজাহান ওমরের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা দাবি করছি। দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতি করে হঠাৎ ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে এনে এমপি হয়েছিলেন শাহজাহান ওমর।’ রাজাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন জানান, থানার বাইরে অবস্থান নেওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাঠালিয়া থানার একটি মামলায় শাহজাহান ওমরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুপুরে আদালতে সোপর্দ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

রাজনৈতিক সূত্র বলছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির একসময়ের প্রতাপশালী নেতা শাহজাহান ওমরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাকে নানা প্রলোভনে প্রলুব্ধ করেন এবং কারান্তরীণ নেতাকে মুক্তি দিয়ে রাজাপুর-কাঠালিয়া আসনে নৌকা নিয়ে নির্বাচনের সুযোগ করে দেন। এ নিয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হলে বিএনপি তাৎক্ষণিক তাকে বহিষ্কার করে। এবং দলটির নেতাকর্মীরা তাকে বিশ্বাসঘাতক-বেইমান আখ্যায়িত করে পল্টিবাজ রাজনীতিক হিসেবে উপস্থাপন করে। ওই সময় তার কাছে পল্টি মারার কারণ জানতে চাইলে তিনি নিজেকে নিয়ে নানান দম্ভোক্তি করেন। এ-ও জানিয়েছিলেন, তার ‘হ্যাডম’ আছে বিধায় আওয়ামী লীগ তাকে মূল্যায়ন করেছে, নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ ৪০ বছরের সম্পর্কচ্ছেদ এবং দেশের ক্রান্তিলগ্নে পল্টি মেরে স্বৈরাচারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ক্ষমতা অর্জন করতে গিয়ে বেশ বিতর্কেও জড়িয়েছিলেন শাহজাহান ওমর।

সূত্র জানিয়েছে, রাজনীতিক শাহজাহান ওমর বীর উত্তম খেতাব নিয়ে বিএনপিতে বেশ আধিপত্য বিস্তার করতেন। এবং নেতাকর্মী থেকে শুরু করে দলের হাইকমান্ডও তাকে সমীহ করত। কিন্তু তিনি এমপি-মন্ত্রী হওয়ার লোভে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এবং নৌকা নিয়ে ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঠালিয়া) আসন থেকে নির্বাচন করেন। পাশাপাশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে নানা বিতর্কিত মন্তব্য করাসহ নিজেকে ‘হ্যাডমওয়ালা’ রাজনীতিক ঘোষণা করে তুমুল হাস্যরসের খোড়াক হন।

রাজাপুর ও কাঠালিয়ার বেশ কিছু সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই দিন বিজয় মিছিল থেকে বরিশাল নগরীর ব্রাউন কম্পাউন্ড এলাকায় শাহজাহান ওমরের ‘বীর উত্তম’ ভবনে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে দীর্ঘ তিন মাসের বেশি সময় ধরে আত্মগোপনে ছিলেন ‘হ্যাডমওয়ালা’ এই নেতা।

সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর ঝালকাঠি বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা সভা-সমাবেশে শাহজাহান ওমরকে চিহ্নিত মীরজাফর আখ্যা দিয়েছেন এবং আওয়ামী লীগের দোসর হিসেবে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসারও দাবি জানিয়েছেন। জানা গেছে, পরে তাকেসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের অভিযুক্ত করে বিএনপির নেতারা একটি মামলাও করেন।

বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমরের এই দুর্দশা তার ক্ষমতা ও লোভের কারণে হয়েছেÑ এমন মন্তব্য করেছেন বরিশাল-ঝালকাঠির রাজনৈতিক বোদ্ধারা। তাদের ভাষায়, ২০২৪ সালের দ্বাদশ নির্বাচন যখন বিএনপি বয়কট করে, তখন তিনি কারান্তরীণ থাকলেও প্রলোভনে পড়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। এবং নানা বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও রাজাপুর-কাঠালিয়া থেকে নৌকা প্রতীক নিয়ে একতরফা ওই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ক্ষমতা অর্জন করতে গিয়ে বেফাঁস মন্তব্যে নিজেকে জোকারে রূপ দেন। বিশেষ করে তখন তিনি নিজেকে ‘হ্যাডমওয়ালা’ রাজনৈতিক উপাধী দেওয়া নিয়ে বিএনপিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে খিস্তিখেউরও করেন, যা নিয়ে তার ওপর অনেকেই সংক্ষুব্ধ ছিলেন। সেই সংক্ষুব্ধ অংশের আক্রোশের শিকার হয়েছেন ‘হ্যাডমওয়ালা’ রাজনীতিক শাহজাহান ওমর।

স্থানীয় বিএনপির নেতারা বলছেন, শাহজাহান ওমর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে হঠাৎ নৌকায় উঠে এমপি হয়ে একূল-ওকূল দুই কূলই হারিয়েছেন। তিনি যতই কেরামতি করেন না কেন, তার দলে ফেরার সব পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং তিনি যতই বুলি আওড়ান না কেন, তৃণমূল বিএনপি এই ‘হ্যাডমওয়ালা’ রাজনীতিককে আর প্রশ্রয় দেবে না। তা ছাড়া তিনি আওয়ামী লীগের দোসর হওয়ায় আগামী দিনগুলো হয়তো কারাবন্দিই থাকতে হচ্ছে। 

আরবি/ এইচএম

Link copied!