চলতি মাসে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ব্যাংকের মাধ্যমে বেশি রেমিট্যান্স আসছে। রপ্তানি আয়ও প্রবৃদ্ধির ধারায়। এরপরও দেশের ব্যাংকগুলোয় ডলারের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাড়তি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কিনছে বেশির ভাগ ব্যাংক। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকের পাশাপাশি কার্ব মার্কেটেও (খুচরা বাজার) ডলারের বিনিময় হার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে।
গতকাল সোমবার এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোয় প্রতি ডলার ১৩০ টাকায়ও কেনাবেচা হয়েছে। এমন সংকটের পেছনে ছয়টি কারণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা বলছে, অস্থিরতা রোধে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
রেমিট্যান্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা দেওয়া যাবে। বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দরে এই সীমা ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করতে গত তিন বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া সব নীতিই ছিল ভুল। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করে ২০২২ সালেই যদি বিনিময় হারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে টাকার এতটা অবমূল্যায়ন ঘটত না। দেশের রিজার্ভও শক্তিশালী অবস্থানে থাকত। মূলত ডলারের বিরাজমান সংকটের সূত্রপাত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই মাসে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির এ প্রক্রিয়া চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময়ে রিজার্ভ থেকে বাজারে বিক্রি করা হয়েছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার। এত পরিমাণ ডলার বিক্রির পরও বাজার স্থিতিশীল করতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২ সালের শুরুতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৫ টাকা থাকলেও সেটি গতকাল সোমবার ১৩০ টাকায়ও লেনদেন হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রলিং পেগ নীতিকে আমলে নিলে ১২০ টাকার বেশি দরে ডলার বেচাকেনার কোনো সুযোগ ছিল না।
বাজার স্থিতিশীল করতে ব্যর্থ হয়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের দায়িত্ব ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) হাতে ছেড়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর সংগঠন দুটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে ডলারের বিভিন্ন দর ঘোষণা করা হয়। যদিও কোনো দরই দেশের ব্যাংক খাতে কার্যকর হতে দেখা যায়নি। এরপর চলতি বছরের মে মাসে বিনিময় হার নির্ধারণে দেশে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করা হয়।
‘ক্রলিং পেগ’ হচ্ছে দেশীয় মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে একটি মুদ্রার বিনিময় হারকে একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে মুদ্রার দরের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন সীমা নির্ধারণ করা থাকে। ফলে একবারেই খুব বেশি বাড়তে পারবে না, আবার কমতেও পারবে না। এ নীতি চালুতে সে সময় বেশ তৎপরতা দেখিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এক্ষেত্রে সুপারিশ ছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেরও (আইএমএফ)। ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালুর সময় ডলারের দর এক ধাক্কায় ১১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১১৮ টাকা পর্যন্ত ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়।
আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এ দর আরও বাড়িয়ে ১২০ টাকায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে এ নীতি কোনো কাজেই আসেনি। বরং দেশের মুদ্রাকে আরও বেশি অবমূল্যায়নের দিকে ঠেলে দিতেই বেশি ভূমিকা রেখেছে। এ অবস্থায় ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি থেকেও সরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ক্রলিং পেগ নীতি ব্যর্থ হওয়ায় বিনিময় হার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বিকল্প পদ্ধতি খুঁজছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ নীতিটি ছিল একটি অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা। বর্তমান পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে নীতির বিকল্প ভাবা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, হঠাৎ ডলার বাজার অস্থিরতার পেছনে মোটা দাগে দুটি কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে।
প্রথমত, বকেয়া পরিশোধের চাপ থাকা, দ্বিতীয় কারণ সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগে ডলার মজুত রাখার প্রবণতা তৈরি হওয়া।
তিনি বলেন, আইএমএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্রলিং পেগ নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে নতুন সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার কোন দিকে যায় সেটি বুঝতে অনেকে হয়তো ডলার ধরে রাখছেন। অপরদিকে বকেয়া পরিশোধের চাপ সামলাতে ব্যাংকগুলো বেশি দরে ডলার কিনছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএমএফসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ২-৩ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা পাওয়া যাবে। এসব ডলার যোগ হলে সংকট অনেকাংশেই কেটে যাবে। এজন্য ক্রলিং পেগ নীতি থেকে বেরিয়ে ডলারকে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া দরকার।
এদিকে নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রেমিট্যান্সের দর ১২৩ টাকা হলে আমদানিকারকে খরচ পড়ছে ১২৪ টাকার বেশি। সে তুলনায় দাম কম পাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। তাদের ডলার নগদায়ন করতে হচ্ছে ১১৯ টাকায়। এতে অন্তত ৫ টাকা ঠকছেন রপ্তানিকারকরা। তবে ডলারের দাম বাড়ায় চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম ২৮ দিনে প্রবাসী আয় ২৪২ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এত কম সময়ে এত বেশি প্রবাসী আয় এর আগে আসেনি। গত আগস্টে নতুন সরকার গঠনের পর প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় এসেছে। প্রবাসী আয়ের এই জোরালো প্রবাহের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কিনছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট মজুত বা রিজার্ভ গত রোববার দিন শেষে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬০৯ কোটি ডলারে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৩৩ কোটি ডলারে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বকেয়া দায় মেটাতে গিয়ে উভয়মুখী সংকটে পড়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। একদিকে ডিসেম্বরের মধ্যে দেনা পরিশোধের চাপ রয়েছে। অপরদিকে পর্যাপ্ত ডলার জোগাড় করতে বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শোকজ পেয়েছে ব্যাংকগুলো।
তথ্যমতে, আসন্ন রমজানকে কেন্দ্র করে বাড়ছে পণ্য আমদানি।
অন্যদিকে আগের বকেয়া এলসি বিল পরিশোধ বেড়েছে। একইসঙ্গে বিদেশে ভ্রমণও বেড়ে গেছে। ফলে যে হারে ডলারের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে সেই হারে জোগান হচ্ছে না। অতিরিক্ত চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাংকগুলো ডলারের ঘোষিত মূল্য এতদিন ১২০ টাকার চেয়ে ৮ থেকে ৯ টাকা বেশি দরে রেমিট্যান্স কিনছে। যার প্রভাব পড়েছে খোলাবাজারেও। এর সুযোগ নিয়েছে কিছু অসাধু চক্র।
এদিকে সম্প্রতি ডলার সংকটের পেছনে ছয়টি কারণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গতকাল সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা জানান, ডিসেম্বর বছরের শেষ মাস। এ কারণে নানাবিধ ঋণ পরিশোধের ভ্যালু ডেট (পেমেন্ট শিডিউল) এই মাসেই বিধায় বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছে, যা আন্তঃব্যাংক ও বাজারে ডলারের জোগান বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখেনি। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের রেটিং অবনমনের কারণে বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর করেসপন্ডেন্ট রিলেশনশিপ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ইউপাস এলসি খোলা (আমদানিকৃত পণ্যের পাওনা পরিশোধে সময় থাকে ২৭০ দিন) বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে।
পেমেন্টের ম্যাচুরিটি ডেফার্ড করা সম্ভব হয়নি ও অফশোর ব্যাংকিং ঋণের আন্তঃপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের মধ্যে বৈদেশিক দেনা পরিশোধসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বাজারে চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। রেমিট্যান্স আহরণে অ্যাগ্রিগেটরদের একচেটিয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ভূমিকা বাজারে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারকে অস্থিতিশীল করেছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ইনফ্লো-আউটফ্লো মিস ম্যাচের কারণেও ডলার বাজারে অস্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজার অস্থিরতা রোধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স আহরণের বিনিময় হার প্রতি ডলার সর্বোচ্চ ১২৩ টাকা (ক্রস কারেন্সি হলে তা ক্রস ক্যালকুলেশন করে প্রতি ডলার ১২৩ টাকা, এর ঊর্ধ্বে হবে না) নির্ধারণ করেছে। এর আগে রেমিট্যান্স সংগ্রহের আনুষ্ঠানিক দাম ছিল ১২০ টাকা। এ ছাড়া ড্যাশবোর্ড, ডেটা মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
আপনার মতামত লিখুন :