শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক, কর ও ভ্যাট বাড়ানোর ফলে নিত্যপণ্যের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর ওপর বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের কাছে ভর্তুকি মূল্যে সব রকমের সার পৌঁছে দেওয়া সরকারের অগ্রাধিকারে রয়েছে। কিন্তু উল্টো সার পরিবহনের ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানোয় বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভ্যাট কমানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে সরকার সার পরিবহনে বা ঠিকাদার ক্ষেত্রে ভ্যাট হার ১০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। ফলে বাজারে সারের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সরবরাহ চেইনের সামগ্রিক ব্যয় বাড়াবে।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ্য থেকে অর্থ ও কৃষি উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে ভ্যাট কমানোর জন্য বলা হয়েছে। তাদের দাবি, সারের মতো অত্যাবশ্যক কৃষি পণ্যের পরিবহন কার্যক্রম সহজতর করার জন্য এবং পরিবহন সংশ্লিষ্টদের আর্থিক ক্ষতি রোধে সারের পরিবহনে আরোপিত ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন সেক্রেটারি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সার পরিবহনে ভ্যাট বাড়ায় সাপ্লাই চেইনে সমস্যা হবে। কারণ লোকসান দিয়ে সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় ট্রাক মালিকরা সার পরিবহন করতে চাইবে না। আবার ভাড়া বাড়ালে সারের দাম বাড়বে। ফলে সরকার ভ্যাট আগের অবস্থানে না নিলে বোরো মৌসুমে সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে বিপাকে পড়তে হবে বলে তিনি জানান।
সার পরিবহনে ১০ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর ছিল, যা পরিবহন কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য হার হিসেবে ব্যবসায়ীরা ধরে থাকেন। কিন্তু বর্তমান ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে পরিবহন কার্যক্রম পরিচালনায় পরিবহন ঠিকাদার এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সার পরিবহন খরচ বৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ চেইনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে ব্যবসায়ীদের দাবি। এতে কৃষি উপকরণের সামগ্রিক খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে।
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। কৃষকদের জন্য সার একটি অত্যাবশ্যক উপকরণ যা দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ জন্য সরকার সারে অব্যাহতভাবে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পক্ষ থেকে বারবার এই ভর্তুকি প্রত্যাহারের জন্য বলা হচ্ছে।
বর্তমানে সরকার নির্ধারিত ইউরিয়া সারের ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজির মূল্য ২৫ টাকা, যা কৃষক পর্যয়ে ২৭ টাকা। ডিএপি সারের ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজির মূল্য ১৯ টাকা, যা কৃষক পর্যয়ে ২১ টাকা। ইউরিয়া সারের ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজির মূল্য ২৫ টাকা, যা কৃষক পর্যয়ে ২৭ টাকা। টিএসপি সারের ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজির মূল্য ২৫ টাকা, যা কৃষক পর্যায়ে ২৭ টাকা এবং এমওপি সারের ডিলার পর্যায়ে প্রতি কেজির মূল্য ১৮ টাকা, যা কৃষক পর্যায়ে ২০ টাকা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান পরিবহন চুক্তিতে আগের ভ্যাট হার বিবেচনায় শর্তাবলি নির্ধারিত হয়েছে। নতুন ভ্যাট হারের কারণে চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন এবং পরিবহন ঠিকাদারদের সঙ্গে নতুন শর্তাবলি নির্ধারণের প্রয়োজন হতে পারে। বর্ধিত ব্যয়ের কারণে পরিবহন ঠিকাদারদের পক্ষে সময়মতো সেবা প্রদান করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, যা সার সরবরাহে বিলম্ব সৃষ্টি করতে পারে।
দেশে এবারে বর্ষা মৌসুমের বাইরেও লম্বা সময়ে অতি বৃষ্টি ও বন্যায় আমনের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি বিঘ্নিত হয়েছে শাক-সবজি ও ফলমূলের আবাদ। নিত্যপণ্যের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চাল থেকে শুরু করে প্রায় সব পণ্যের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। যদিও সবজির দামে কিছুটা স্বস্তিতে আছে। য
দিও বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে চাল-গমসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক পণ্যের আমদানি শুল্ক কমানোসহ কিছু ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে ব্যাংকিং সুবিধাও। এরপরও চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করা হলেও আমদানিকারকদের তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। বিপরীতে অতি সম্প্রতি ৯০টিরও বেশি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। যা পণ্য বাজারে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে।
এদিকে বর্তমানে সারের বাজারে তেমন কোনো সুসংবাদ নেই বললেই চলে। ইতোমধ্যে বাজারে প্রায় সব রকম সারের দাম বেড়েছে, কোনো কোনোটি প্রায় দ্বিগুণ। অনেকক্ষেত্রে ডিলারের কাছে পর্যাপ্ত সারও পাওয়া যায় না বলে কৃষকের অভিযোগ রয়েছে। কৃষকের ভাষ্য, ডিলারদের দোকানে সারের সরকারি মূল্য তালিকা টাঙানো থাকলেও কোথাও এ দামে সার পাওয়া যায় না।
জানা গেছে, পটুয়াখালীতে চলমান তরমুজ আবাদ মৌসুমে সার সংকটে পড়েছেন চাষিরা। প্রয়োজনের তুলনায় সরবরাহ কম থাকার সুযোগে ব্যবসায়ীরাও বেশি দামে সার বিক্রি করছেন। অসহায় কৃষকরাও বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার বেশি দামেও মিলছে না সার।
পটুয়াখালীতে তরমুজ মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ চলতি জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ ২০ হাজার ২৪০ টন বিভিন্ন প্রকারের সারের চাহিদা দিলেও সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৩৭৩ টন। সার সংকটের কারণে এবার তরমুজের উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন চাষিরা।
পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জেলার ৮টি উপজেলায় ২৩ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত জেলায় ১৩ হাজার ১৯৯ হেক্টর জমিতে তরমুজ রোপণ করা হয়েছে।
জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরমুজ উৎপাদন হয় বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী গলাচিপা উপজেলায়। এ বছর এখানে ৮ হাজার ৯৫০ হেক্টর জমিতে তরমুজ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও রাঙ্গাবালীতে ৬ হাজার ৩৫০ হেক্টর, বাউফলে ৩ হাজার ৫২০ হেক্টর, কলাপাড়ায় ১ হাজার ৭৫০ হেক্টর, দশমিনায় ১ হাজার ৭২০ হেক্টর, সদর উপজেলায় ৮০৫ হেক্টর, দুমকিতে ৩৫০ হেক্টর ও মির্জাগঞ্জে ১৫৫ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। গত বছর এ জেলায় ২০০ কোটি টাকার তরমুজ উৎপাদন হয়েছে বলেও জানায় সূত্রটি।
কৃষকরা জানিয়েছেন, প্রতি একর জমিতে টিএসপি, ইউরিয়াসহ বিভিন্ন প্রকারের ১০ থেকে ১২ বস্তা সার প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজন মাফিক সার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। সার সংকটের কারণ দেখিয়ে ডিলারও বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন।
এ ব্যাপারে পটুয়াখালী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. খাইরুল ইসলাম মল্লিক বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে এ জেলায় সারের সংকট চলছে। চলতি জানুয়ারি মাসে আমরা ২০ হাজার ২৪০ টন বিভিন্ন প্রকারের সারের চাহিদা দিলেও সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৩৭৩ টন।
তিনি আরও জানান, পটুয়াখালী জেলায় সারের গোডাউন ডিপো না থাকায় জেলার ডিলাররা পার্শ্ববর্তী জেলা বরগুনা থেকে বরাদ্দের সার উত্তোলন করত। তবে সংকট মোকাবিলায় আমরা বরগুনার পরিবর্তে বরিশাল গোডাউন ডিপো থেকে ডিলারদের সার সরবরাহের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাপ্তরিক চিঠি দিয়েছি। আশা করছি, শিগগিরই সার সংকট কেটে যাবে। তবে বেশি দামে কেউ সার বিক্রি করলে তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :