ছাত্র-জনাতার গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে প্রতিবেশি দেশের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ন বাড়ছে বাংলাদেশের। ইতোমধ্যে বিচারের মুখমুখি করতে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছে ঢাকা। আবার ড. মোহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ব্যবসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে।
এদিকে চট্টগ্রামে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের পতাকা ওড়ানোর রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন নাকচ করায় নাখোশ ভারত। অন্যদিকে দেশটির দাবি, বাংলাদেশে অত্যাচারিত হচ্ছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়। এসবসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানাভাবে ঢাকার ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে দিল্লি।
শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য ভারতের কাছ থেকে বিভিন্ন অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ভারত সফররত শেখ হাসিনা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা রয়েছে। ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনে হচ্ছে। আগামী দিনেও কেনা হবে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (প্রায় ৪২৮ কোটি টাকা) সমরাস্ত্র কেনার চুক্তি সই করেছে সেদেশের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব বিনয় মোহন কাত্রা। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে করা চুক্তির আওতায় অস্ত্র ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ভারতের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের`ডিফেন্স লাইন অব ক্রেডিট` কার্যকর করতে ঋণ নেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।
প্রতিরক্ষা সরঞ্জমের মধ্যে রয়েছে- প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলার খরচে ৫টি ব্রিজ লেয়ার ট্যাংক (বিএলটি-৭২), প্রায় ২ দশমিক ২ মিলিয়ন খরচে ৭টি পোর্টেবল স্টিল ব্রিজ (বেইলি) ও টাটা গ্রুপ থেকে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার খরচে ১১টি মাইন প্রোটেক্টিভ যানবাহন, মাহিন্দ্রা এক্সইউভি ৫০০ অফ-রোড যানবাহন, বুলেট প্রুফ হেলমেট, ৪ কোটি রূপি মূল্যের ২ ধরনের বিস্ফোরক, প্রায় ৩ কোটি রূপি মূল্যের ২১ ধরনের কাঁচামাল, প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ রূপি মূল্যের ১০ ধরনের সরঞ্জামসহ আরও কিছু সরঞ্জাম।
এছাড়া, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জন্য একটি ফ্লোটিং ডক, লজিস্টিক জাহাজ ও তেলের ট্যাঙ্কারসহ বিভিন্ন ধরনের সরঞ্জামের নাম তালিকায় আছে।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ভারত বাংলাদেশকে আর্টিলারি গান, মর্টার, রকেট, ক্ষেপণাস্ত্র, ইলেকট্রনিক ও প্রকৌশল সরঞ্জাম, রাডার, হেলিকপ্টার, সামরিক রেক, জাহাজ নির্মাণ পরিষেবা ইত্যাদি দিতে আগ্রহী।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের আস্থাভাজন শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ওই চুক্তি আদৌ বাস্তবায়ন করবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছে ভারত।
এদিকে, হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, তুরস্ক থেকে ট্যাংক কিনতে ইতোমধ্যে চুক্তি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। এমন সময় এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যখন বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। এবং দিল্লির সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ঢাকার টানা-পোড়েন চলছে। যা নিয়ে দেশটির গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল।
তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের ট্যাংক কেনার প্রসঙ্গে শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) সাপ্তাহিক সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। ট্যাংক প্রসঙ্গে রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘নিরাপত্তা-জনিত সব বিষয়ের ওপরই আমাদের তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে। প্রয়োজনে আমরা পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া কোরের জন্য ২৬টি হালকা ট্যাংক কেনার জন্য তুর্কি ফার্ম (Otokar Otomotiv V Savunma Sanai A.S) এর সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ট্যাংকগুলি ২০২৫ সালে সরবরাহ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ওটোকার বিভিন্ন ধরনের ট্যাংক তৈরি করে। যার মধ্যে রয়েছে আলতাই, যা তুর্কি সেনাবাহিনীর প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক। এর ওজন প্রায় ৬৫ টন।
তবে আলতাই ট্যাংকটির ওজন বেশি হওয়ার কারণে ওই কোম্পানির কাছ থেকে ১৯ টন ওজনের আরমা ট্যাংক (Otokar ARMA) কিনতে পারে। বাংলাদেশের আর্দ্র ভূমি ও জলাভূমিতে হালকা এই ট্যাংকটি সহজেই চলাচল করতে পারবে।
সাম্প্রতি পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা প্রধান দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক অন্যতম। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মতো মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে জোটের অংশ হিসেবে তু্রস্ক থেকে ট্যাংক কেনার সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা খাতে বড় কোনো হুমকি না থাকা সত্ত্বেও ট্যাংক কেনার ঘটনাকে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ভারত মনে করছে, ভারতের সঙ্গে বড় ধরণের সামরিক চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ড. মোহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার এই ধরনের চুক্তি দিয়ে ভারতকে বিরক্ত করার চেষ্টা করছেন।
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ব্রিটিশ ইংরেজি দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টার ভারতের উত্তর-পূর্বাংশকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করার হুমকি দেওয়ার পর সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করেছে ভারত। যদিও গত ডিসেম্বরের মাঝের দিকের এই মন্তব্যের বিষয়ে ‘কড়া প্রতিবাদ’ জানিয়েছিল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত অতিক্রমকারী নদীগুলোতে নতুন ভাসমান সীমান্ত চৌকি তৈরি করেছে।
হিন্দুস্তান টাইমসের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতকে পাশ কাটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সামরিক ক্রয় এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারের ঘটনাগুলো ভারতের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্ক থেকে ট্যাংক কেনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত বাংলাদেশকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে তুরস্ক থেকে ট্যাংক কেনার বিষয়ে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মিডিয়া ও সংবাদ সংস্থা ‘আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর’ বা আইএসপিআর।
আপনার মতামত লিখুন :