ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

রেস্টুরেন্টে খাবারের সঙ্গে শিল্পের ঘ্রাণ

খোরশেদ আলম রাজু , নওগাঁ

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৪, ০১:১৭ এএম

রেস্টুরেন্টে খাবারের সঙ্গে শিল্পের ঘ্রাণ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

শিল্প-সংস্কৃতি একটি জাতির চেতনাকে যেমন বহন করে তেমনি তার রুচি, মনস্তত্ব, বিশ্বাস, নীতিবোধ এবং আদর্শকে ধারণ ও রক্ষা করে। 
রেস্টুরেন্টে ভোজনের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্যের ঘ্রাণ পাওয়া যায়, এমন দৃশ্য আমাদের দেশে খুব কমই লক্ষ্যণীয়। তবে নওগাঁর পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্টের এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নজর কেড়েছে ভোজনরসিক তথা সৃজনশীল মানুষদের।

‘গাঁজা মহল’ নামে পরিচিত নওগাঁ। নানা ইতিহাসের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্র মুক্তির মোড়ে আজও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে একাধিক ব্রিটিশ স্থাপনা।

সেখানে নওগাঁ জেলার সব শ্রেণি-পেশা মানুষের চলাফেরা হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ও শিল্প-সাহিত্য চেতনাসম্পন্ন মানুষের ওঠাবসা লক্ষ্যণীয়। এক পাশে পার্ক, অন্য পাশে ব্রিটিশ আমলের স্থাপনা, মাঝখানে পিচঢালা ভিআইপি প্রশস্ত রাস্তা, সেই রাস্তাসংলগ্ন সমবায় মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্টের অবস্থান।

রেস্টুরেন্টে বসে জেলা পরিষদ পার্কের সৌন্দর্য সহজেই অবলোকন করা যাবে এমন চিন্তা থেকেই রেস্টুরেন্টের নাম ‘পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্ট’।

দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে এমনটাই জানিয়েছেন রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী, দেশ টিভির প্রাক্তন অনুষ্ঠান প্রধান ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রবিউল করিম। পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্টটি আর দশটা রেস্টুরেন্ট থেকে একটু ব্যতিক্রম। এর প্রতিটি দেয়ালে নিপুণ হাতে শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় উঠে এসেছে প্রাচীন ও আধুনিক সংস্কৃতির এক অপরূপ মেলবন্ধন। বাঁশ, বেত আর গাছের গুঁড়ির সঙ্গে প্রকৃতির বিভিন্ন গাছের সংমিশ্রণ এক অন্যরকম মায়াজাল বিস্তার করে ভোজনরসিকদের। 

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারতীয় কবি জয় গোস্বামী, অন্যতম চিত্রশিল্পী গণেশ হালুই, ধীরাজ চক্রবর্তী, সংগীতশিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী, আমাদের জনপ্রিয় কবি হেলাল হাফিজ, লেখক ও দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম, ভাষা আন্দোলনে অন্যতম প্রাণপুরুষ ভাষাসংগ্রামী আব্দুল মতিন, আহমেদ রফিকসহ দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পীদের নিজ হাতে আঁকা চিত্র, কথামালা, কবিতার পঙ্ক্তিসহ নানা বাক্যের সমাহার নিয়ে পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্টে রয়েছে আর্ট গ্যালারি। এই অমূল্য সাংস্কৃতিক দলিল সত্যিই বিরল। কেননা এসব কবি ও শিল্পী-সাহিত্যিক অধিকাংশই জীবনের প্রথম স্বহস্তে আর্ট পেপারের ওপর তুলির আঁচড়ে নিজেদের দৃশ্যায়িত করেছেন।

পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্ট শুধু আর্ট গ্যালারিতেই শেষ না। রেস্টুরেন্টের এক পাশে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক বইয়ের লাইব্রেরি। যা জ্ঞানপিপাসুদের আন্দোলিত করে। রেস্টুরেন্টে প্রথম প্রবেশে যে কেউ একটু সংশয়ে পড়তে পারেন। তবে কিছু পরেই ওয়েটারের দেওয়া খাবার তালিকা হাতে পাওয়ার পরেই নিশ্চিত হওয়া যাবে এটা একটা রেস্তোরাঁ। রেস্টুরেন্টের অন্দর ও বাইরের এমন চিত্রাকর্ষক ডেকোরেশন যে কারো মন কেড়ে নিতে বাধ্য। রেস্টুরেন্টের খাবারের মান ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ নওগাঁবাসী। এখানে ছোটখাটো পার্টি বা সেমিনার করারও সুব্যবস্থা রয়েছে।
পরিবার নিয়ে খেতে আসা শিশুদের খেলার জন্য বড় পরিসরে জায়গা না থাকলেও বিনোদনের জন্য দোলনার ব্যবস্থা আছে। আর দোলনায় বসে কফি হাতে হালকা দোল খেতে খেতে খুব সহজেই জেলা পরিষদ পার্কের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। রেস্টুরেন্টে আসা প্রায় সবাই এমন স্মৃতি ধরে রাখতে সেলফি তুলতে ভুল করেন না।

রেস্টুরেন্টে খেতে আসা জেলা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আশরাফুল নয়ন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, একটি সমাজ, রাষ্ট্র বা পরিবার যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে ঠিক সে সময় তাকে সুস্থ বা পরিবর্তন করতে কবি-সাহিত্যিকের লেখনী শক্তিটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্ট হলো একটি খাবার জায়গা। জিহ্বায় খাবারের স্বাদের পাশাপাশি সাহিত্যের একটু নির্যাস যদি কেউ মগজে নিতে পারে তাহলেই সার্থকতা। রেস্টুরেন্টে সাহিত্যের এমন দৃশ্য সত্যিই মুগ্ধ করেছে। এর স্বত্বাধিকারী নিঃসন্দেহে একজন সাহিত্যমনা মানুষ, তাই এমনটা সম্ভব হয়েছে।

এনাম হক নামে আরেকজন বলেন, আমি কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছি। রেস্তোরাঁয় আলোকসজ্জাসহ বিশেষ স্থানে ব্যক্তির ছবিও দেখেছি কিন্তু এমন সাহিত্যিক দৃশ্য আমার চোখে পড়েনি। এটা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ।

রেস্টুরেন্টের সঙ্গে এমন দেশবরেণ্য শিল্পী-সাহিত্যিক, লেখক ও দার্শনিকের লেখনী কেন এবং কীভাবে সংগ্রহ করলেনÑ এমন প্রশ্নে পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী রবিউল করিম বলেন, আমি দীর্ঘ সময় ধরে গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, সে সুবাদে পেশাগত কারণে হলেও এক সময় ব্যক্তিগতভাবে এসব মানুষের সঙ্গে একান্ত সুসম্পর্ক হয়। মানুষ তো চিরকাল বাঁচে না, বেঁচে থাকে তার কর্ম। এসব বিখ্যাত মানুষগুলোকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার ভাবনা থেকেই এই মাধ্যম বেছে নেওয়া। রেস্টুরেন্টে এগুলো প্রদর্শন করার একটাই কারণ বা উদ্দেশ্য সেটি হলো একজন লেখক, কবি, শিল্পী-সাহিত্যিকই পারেন ঝিমিয়ে পরা রাষ্ট্র বা সমাজকে জাগিয়ে তুলতে।

রেস্টুরেন্টে খেতে আসা কেউ যদি এ ধরনের দৃশ্য অবলোকনে সামান্য অনুসন্ধিৎসু হন, ব্যক্তিটিকে জানতে বা পড়তে উদ্বুদ্ধ হন, তাহলেই সার্থকতা। পেটের ও মগজের ক্ষুধা দুটোকেই যদি আপনি নিবারণ করতে পারেন তবেই না আপনি সত্যিকারের ক্ষুধা নিবারকের ভূমিকায় যেতে পারবেন। পার্ক ভিউ রেস্টুরেন্ট সেই চেষ্টাটাই করে যাচ্ছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!