ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪

ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, বন্ধ হয়ে গেছে

শাওন সোলায়মান

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪, ০১:৩৭ এএম

ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, বন্ধ হয়ে গেছে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দেখতে দেখতে শেষ হতে চলল আরও একটি বছর। ঘটনাবহুল ২০২৪ সালে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) এবং টেলিযোগাযোগ খাতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়া। ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার কারণ হিসেবে তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের উক্তি- ‘ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, বন্ধ হয়ে গেছে’ দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এ ছাড়া থাকছে আইসিটি এবং টেলিকম খাত নিয়ে ২০২৪ সালের ঘটনাবলি। 

মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ: ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করেছিল হাসিনা-পলক প্রশাসন। প্রথম দফায় ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় দেশজুড়ে মোবাইল ইন্টারনেটের কাভারেজ সীমিত করা হয়। ১৮ জুলাই থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একই দিন রাত থেকে দেশজুড়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে দেশের সাধারণ নাগরিকরা ইন্টারনেট সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানতে চাইলে সাবেক প্রতিমন্ত্রী পলক জানিয়েছিলেন, ইন্টারনেট সঞ্চালনের লাইন পুড়িয়ে দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। নিজের এই বক্তব্য প্রমাণে ২০ জুলাই রাজধানীর তেজগাঁওয়ে পুড়ে যাওয়া ডাটা সেন্টার পরিদর্শনের মতো নাটকও করেন তিনি। প্রকৃতপক্ষে কোনো ডাটা সেন্টারই পুড়ে যায়নি। সপ্তাহখানেক পর ২৭ জুলাই রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে পলক বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ করিনি। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করেনি। ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে। পলকের এমন বক্তব্য দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। সাধারণ নাগরিক থেকে টেলিকম পেশাজীবী সবাই জানতেন যে সরকারের পক্ষ থেকেই ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল।

ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে নানামুখী সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় মোবাইল ইন্টারনেট। ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট চালু করা হয়। যদিও তার গতি ছিল ধীর। অবশ্য ইন্টারনেট চালুর কয়েক দিনের মধ্যে আবার সেটি বন্ধ করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তীব্রতা বাড়লে ৪ আগস্ট আবারও বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের ইন্টারনেট। শেষমেশ ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর চালু হয় ইন্টারনেট।

বন্ধ ফেসবুক-ইউটিউব-টিকটক: ২০২৪ সালে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি যতটাই সমালোচিত ছিল, ঠিক ততটাই আলোচিত ছিল ফেসবুক, ইউটিউব এবং টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখার বিষয়টি। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে, আন্দোলন সমন্বয়ে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত করা এবং ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের বর্বরতা গোপনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করেছিল সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। দীর্ঘদিন বন্ধের পর ইন্টারনেট চালু হলেও বন্ধ রাখা হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। এ সময় সাধারণ ব্যবহারকারীদের অনেকেই ভিপিএন (ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন। যদিও পরবর্তী সময়ে জানা যায় যে, পলকসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন মন্ত্রী ও কর্মকর্তা বিশেষ ব্যবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেছেন। প্রায় ১৩ দিন বন্ধ থাকার পর ৩১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ফেসবুক, ইউটিউব এবং টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো বাংলাদেশের ব্যবহারকারীদের জন্য চালু করা হয়। ফেসবুক, ইউটিউব তথা গুগল এবং টিকটকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তলবের মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালে। এসব প্ল্যাটফর্মে সরকারবিরোধী গুজব ছড়ানো হয়, এমন অভিযোগে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিদের তলব করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রশাসন। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফেসবুক, গুগলের মালিকানাধীন ইউটিউব এবং চীনভিত্তিক টিকটকের প্রতিনিধিদের তলব করা হয়।

এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বিষয় জানতে চেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেইল করেছিল বিটিআরসি। ৩০ জুলাইয়ের মাঝে ই-মেইলের জবাব এবং ৩১ জুলাই বিটিআরসিতে সশরীরে প্রতিনিধি প্রেরণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলেছিল বিটিআরসি। যদিও সরকারের এই তলবে সাড়া দেয়নি ফেসবুক এবং গুগল। টিকটক ই-মেইল বার্তায় নিজেদের বিষয়ে একটি ব্যাখ্যা দিলেও এ জন্য সময় চেয়েছিল বাকি দুইটি প্ল্যাটফর্ম। যদিও ব্যাখ্যা দেওয়ার আগেই পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের।

কমেছে স্টার্টআপে বিনিয়োগ: বাংলাদেশে পরিচালিত বিভিন্ন স্টার্টআপে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে স্টার্টআপে বিনিয়োগ ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। ঢাকাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসেল পার্টনার্সের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে এসে এই বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৫ মিলিয়ন ডলার। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে ঘটনা অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, দেশে স্থিতিশীল সরকার না থাকায় বিনিয়োগকারীরা অর্থ লগ্নির ঝুঁকি নিচ্ছেন না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

ই-কমার্সে ক্ষতি ১৭০০ কোটি: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় দেশের ই-কমার্স খাতে প্রায় এক হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। গত ৩১ জুলাই রাজধানীর বনানীতে ই-কমার্স খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-ক্যাব নিজেদের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানায়। দেশে ই-কমার্সসেবা চালুর পর থেকে ই-কমার্সের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাত ছিল এটি। সে সময় ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, ডিজিটাল মার্কেটার, কনটেন্ট ডেভেলপার, স্টার্টআপ এবং ক্ষয়ক্ষতি বিষয়ে সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় প্রথম ১০ দিনেই ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।

ফ্রিল্যান্সারদের দেশত্যাগ: চলতি বছরে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আরেক আলোচিত বিষয় ছিল প্রযুক্তি খাতের ফ্রিল্যান্সারদের দেশত্যাগ করা। আন্দোলনের সময় দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করা হলে কাজ হারানোর শঙ্কায় পড়েন ফ্রিল্যান্সাররা। পাশাপাশি আউটসোর্সিং এবং কনট্যাক্ট সেন্টার তথা বিপিও প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তর্জাতিক গ্রাহক হারানোর মতো গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। এমন প্রেক্ষাপটে অনেক প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে কার্যক্রম চলমান রাখার চেষ্টা করেন। দেশের বাইরে যাদের অফিস ছিল, তারা সেখান থেকে এবং যাদের অফিস ছিল না তারা হোটেলকক্ষেই কাজ চালু করেন। ভিসা আছে এমন পেশাজীবী, ফ্রিল্যান্সার ও ব্যবসায়ীরা দ্রুতগতির ইন্টারনেটের জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত, দুবাই, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে চলে যান। অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়ার সুযোগ থাকায় ফ্রিল্যান্সারদের একটি বড় অংশ পাড়ি জমান নেপালেও। সে সময় নেপালের ট্যুরিজম বোর্ড নিজেদের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানায়, শুধু জুলাই মাসে বাংলাদেশ থেকে ৩ হাজার ৪৭০ জন পর্যটক নেপালে প্রবেশ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্তত ১ হাজার পর্যটক জুলাই মাসের শেষ দুই সপ্তাহে প্রবেশ করেছেন বলে ইমিগ্রেশন বিভাগের বরাতে জানায় ট্যুরিজম বোর্ড। নেপালের একটি সূত্র জানিয়েছে, অন্তত ৬০০ জন ফ্রিল্যান্সার বা আইটি পেশাজীবী এই মুহূর্তে নেপালে অবস্থান করছেন।

মোবাইল অপারেটরদের তারবিহীন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট: ২০২৪ সালে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের জন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটরদের তারবিহীন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটসেবা চালু হওয়া। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এত দিন শুধু ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার তথা আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ করত। আর সেটি ছিল ওয়্যারড অর্থাৎ তারের মাধ্যমে যুক্ত ব্রডব্যান্ড। বছরের শুরুর দিকে ফেব্রুয়ারিতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি টেলিকম অপারেটরদের ফিক্সড ওয়্যারলেস অ্যাকসেস (এফডব্লিউএ) দেওয়ার অনুমতি দেয়। এর ফলে অপারেটররা তার ছাড়াই যেকোনো স্থানে রাউটারের মাধ্যমে দ্রুতগতির ইন্টারনেটসেবা অফার করতে পারছে। মোবাইল অপারেটরগুলো এই সেবা সাধারণত ফাইভ-জির উচ্চগতির ইন্টারনেট দিয়ে করে থাকে। তাই আগামীতে দেশে ফাইভ-জি চালু হলে এই সেবা বৃহৎ পরিসরের গ্রাহকদের সেবা দিতে সক্ষম হবে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

আরবি/জেডআর

Link copied!