দেশের স্টার্টআপগুলোতে বিনিয়োগের নিম্নমুখী হার অব্যাহত রয়েছে। ২০২২ সাল থেকে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কমছে বিনিয়োগের পরিমাণ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলো দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ পেয়েছে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মানের নিম্নমুখী প্রবণতায় বিনিয়োগকারীরা অর্থ লগ্নিতে আস্থা পাচ্ছেন না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না এলে এ অবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হবে বলেও আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের। এমন অবস্থায় বেশ বিপাকেই রয়েছে দেশীয় স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো।
২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ঢাকাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান লাইটক্যাসল পার্টনার্স। ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ বিনিয়োগ প্রতিবেদন: এক দশকের পর্যালোচনা’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে ২০২৪ সালের তথ্যও উঠে আসে।
এতে দেখা যায়, ২০২৪ সালে স্টার্টআপগুলো ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। এর মাধ্যমে দেশীয় স্টার্টআপ খাত ২০১৩ সাল থেকে অদ্যাবধি মোট ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগপ্রাপ্তির মাইলফলক অর্জন করতে পারে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই বিনিয়োগের ৯০ শতাংশই এসেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ সালে সর্বোচ্চ ৪৩৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পায় বাংলাদেশি স্টার্টআপগুলো। ২০২২ সালে সেটি কমে হয় ১২৫ মিলিয়ন ডলার, যা অব্যাহত থাকে ২০২৩ সালেও। সে বছর ৫০ শতাংশ কমে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭১ মিলিয়ন। চলতি বছর সেটি আরও ৫০ শতাংশ হ্রাস পায়। ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে সেটি ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ২ ডলার অর্থাৎ ২০২৩ সালের প্রথমার্ধের তুলনায় চলতি বছরের প্রথমার্ধে বিনিয়োগ হ্রাস পায় ৬৫ শতাংশ। ২০২৪ সালে সর্বাধিক বিনিয়োগ পেয়েছে লজিস্টিকস ও মবিলিটি খাতের স্টার্টআপ। ১৩.৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এসেছে এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এর মধ্যে শুধু ‘পাঠাও’তেই বিনিয়োগ এসেছে ১২ মিলিয়ন ডলার। পরের অবস্থানগুলোতে যথাক্রমে রয়েছে ফিনটেক (৭.৬ মিলিয়ন), জ্বালানি ও জলবায়ু (৩.৩. মিলিয়ন), সফটওয়্যার ও এন্টারপ্রাইজ (৩.৩ মিলিয়ন), ই-কমার্স ও রিটেইল (৩ মিলিয়ন), শিক্ষা বা এডটেক (১.৫ মিলিয়ন), স্বাস্থ্য (১.৩ মিলিয়ন) এবং ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার (১.২ মিলিয়ন)।
খাতভিত্তিক বিনিয়োগ পাওয়া শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে শপ আপ (৬.৫ মিলিয়ন-এডটেক), সোলশেয়ার (১.২ মিলিয়ন-জ্বালানি), মার্কোপোলো ডট এআই (১.৫ মিলিয়ন-সফটওয়্যার), প্রিয়শপ (২.৩ মিলিয়ন-ইকমার্স), টেন মিনিট স্কুল (১ মিলিয়ন-এডটেক), আরোগ্য (১ মিলিয়ন-স্বাস্থ্য) এবং ফসল (১ মিলিয়ন-অ্যাগ্রিকালচার)। বিনিয়োগে এগিয়ে আছে ভেঞ্চার ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠানগুলো। ২০২৪ সালে বিনিয়োগের ৯৪ শতাংশই এসেছে ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগের হার হ্রাসের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণে বিনিয়োগের অনিশ্চয়তাকে কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। নিত্যপণ্যের ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ‘চালডাল’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী ওয়াসিম আলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, স্টার্টআপে অর্থ লগ্নির ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা দেখেন যে, প্রবৃদ্ধির (গ্রোথ) মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ভ্যালুয়েশন বাড়ার সুযোগ রয়েছে কি না। কোনো বিনিয়োগকারী যদি দেখেন যে, এই সুযোগ রয়েছে তাহলে সে বিনিয়োগে আগ্রহী হন। এ বছরের শুরুতেই নির্বাচন ছিল। তখন বিনিয়োগকারীরা দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। যেমন চালডালেই বিনিয়োগের জন্য মার্চ-এপ্রিলে বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগাযোগ হতে থাকে, সেপ্টেম্বরে এসে বিনিয়োগ চূড়ান্ত হতো।
বিনিয়োগকারীরা প্রস্তাব অনেক খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করেন। জুলাই-আগস্ট আসতে আসতে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান হয়। এমন প্রেক্ষাপটে স্টার্টআপের প্রবৃদ্ধি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ফলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের সুরক্ষা নিয়ে অনিশচয়তায় পড়েন, তারা বিনিয়োগে অনাগ্রহী হন। তখন বিনিয়োগকারীরা একেবারেই পিছু হটেন। আমরাও যোগাযোগ করলে তারা সিদ্ধান্ত জানাতে সময় চান। এ অবস্থা আগামী বছরের আগস্ট নাগাদ কাটতে পারে। তবে ডিসেম্বরে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে এই সময় আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে।
বাংলাদেশের বাজার নিয়ে বিনিয়োগকারীরা এখনো দ্বিধান্বিত উল্লেখ করে ওয়াসিম আলিম আরও বলেন, টেকসই সরকার আসার আগে দেশে ‘সিভিল আনরেস্ট’ হতে পারে। আবার সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে নীতিমালায় পরিবর্তন আসতে পারে। সব মিলিয়ে দেশের স্টার্টআপ খাতে প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ফলে বিনিয়োগকারীরাও দ্বিধান্বিত। তাদের কাছে বাংলাদেশ ‘আনস্টেবল মার্কেট’।
পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার মান নিম্নমুখী হওয়াকে বিনিয়োগে ভাটা পড়ার কারণ হিসেবে দেখছেন দেশের শীর্ষ জব পোর্টাল বিডি জবসের প্রতিষ্ঠাতা ও টেকসই অর্থনীতির ভিত তৈরিতে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য এ কে এম ফাহিম মাশরুর।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে রূপালী বাংলাদেশকে ফাহিম বলেন, বিনিয়োগকারীরা অর্থ দিচ্ছেন ডলারে, কিন্তু স্টার্টআপগুলো আয় করছে টাকায়। বিনিয়োগকারীদের ডিভিডেন্ট দিতে হলে ডলারের বিপরীতে টাকার খরচ বাড়বে, যেটি বিনিয়োগের জন্য নেতিবাচক। বিগত দুই বছর যাবত টাকার মান কমছে। যত দিন এটা স্থির অবস্থায় না আসবে, বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাবেন না।
বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে উদ্বিগ্ন এই খাতের উদ্যোক্তারাও।
ওয়াসিম আলী বলেন, সব স্টার্টআপই চার-পাঁচ বছরের বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয়। স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগকৃত অর্থ মূলত দুইটি বড় খাতে খরচ হয়। এক, তাদের দ্রুত বড় হতে হয় (ভ্যালুয়েশন বৃদ্ধি) এবং সফট বিনিয়োগ, মার্কেট রিসার্চের মতো খাতের খরচ। এভাবে বিনিয়োগ চলতে থাকলে একপর্যায়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠান টেকসই অবস্থান অর্জন করবে। বিনিয়োগ এলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে, আবার প্রবৃদ্ধি না থাকলে বিনিয়োগ আসবে না। অনেক সময়েই এটা একটা চক্রের মধ্যে পড়ে যায়।
বিনিয়োগের নিম্নমুখিতায় স্টার্টআপগুলো বেশ বিপাকে রয়েছে। কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে না পারাও স্টার্টআপের জন্য ঝুঁকির। যেমন চালডালেই পরিকল্পনা ছিল এ বছর নতুন ২ হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া, যা পারিনি। অর্থাৎ আমাদের ‘গ্রোথ’ হচ্ছে না। এ রকম চলতে থাকলে স্টার্টআপ ব্যবসা টিকিয়ে রাখাও খুব কঠিন হয়ে যাবে।
অবশ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধির আশা ছিল খাতসংশ্লিষ্টদের। তবে সেই আশা এখন অনেকটাই স্তিমিত।
এ বিষয়ে ফাহিম মাশরুর বলেন, অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশ সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। দেশের শাসনভারে তার আসার মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিয়ে বেশ প্রত্যাশা তৈরি হয়। তবে তাকে রাজনৈতিক ইস্যুতেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যে ‘কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং’ হতে পারত, তিনি সেদিকে নজর দিতে পারছেন বলে মনে হয় না।
তবে আগামীদিনের জন্য স্টার্টআপ খাতের উন্নয়নে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। প্রয়োজনে অন্যান্য খাতের বিনিয়োগ সাশ্রয় করে স্টার্টআপগুলোকে সহায়তা করার জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা।
আপনার মতামত লিখুন :