পদোন্নতি বৈষম্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেশি পুড়ছেন জনতা ব্যাংকের নির্বাহীরা। লাভবান হচ্ছেন রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারা। দ্রুত পদোন্নতি পাওয়া রূপালী ব্যাংকে কর্মকর্তাদের জন্য আর শূন্যপদ নেই। না থাকায় অন্য ব্যাংকে তাদের পদায়ন করছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ।
অন্যদিকে জনতা ব্যাংকে ডিসেম্বরে ১২টি পদশূন্য হবে। নির্বাহীদের প্রবল আপত্তি এবং পদোন্নতি বৈষম্য রয়েছে। তবুও জনতায় অন্য ব্যাংক থেকে নির্বাহী পদায়ন করা হবে।
যদিও ব্যাংকে শুদ্ধাচার ফেরাতে এবং পদায়ন ঠেকাতে ২০১৯ সালে আওয়ামী সরকারের গঠিত প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি তুলেও আমলে নেয়নি মন্ত্রণালয়। ফলে জনতা ব্যাংকের ৪৯৩ জন নির্বাহী ক্ষোভের আগুনে পুড়ছেন। জনতার ১৭ হাজার ৫৫৭ কর্মীর মধ্যে পদোন্নতিও আটকে যাচ্ছে। নির্বাহী পর্যায়ে পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় নিচের পদে চাপ বাড়তে থাকায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।
দক্ষতা ও প্রকাশনা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি হচ্ছে না। তাদের মধ্যে আছেন- ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) ১৪৭ ও অ্যাসিসট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (এজিএম) ৩৪৬ জন।
ব্যাংকে চাকরি পদবির শেষ সীমায় আছেন এখন জিএম পদের (জেনারেল ম্যানেজার) নির্বাহীরা। তারা সরকারের এমন কর্মকাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। অধিকাংশ জিএম চাকরি বাঁচানোর তাগিদে ক্ষোভ পুষে (ব্যাচভিত্তিক) জুনিয়র এমডি ও ডিএমডির নির্দেশনায় কাজ করছেন। শেষ চূড়ায় এসে কয়েকজন জিএম জানিয়েছেন, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও জিএম পদে নিয়োগ, পদোন্নতি এখন ব্যাংকের কাছে নেই। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে শীর্ষ পদের বেশির ভাগই চলছে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে। দক্ষতা থাকলেও প্রজ্ঞাপনের কারণে আটকা পড়ায় স্থবির জনতা ব্যাংক।
তবে এসব বিষয়ে জনতা ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) অনুমতি ছাড়া নির্বাহীদের কথা বলা নিষেধ। ইতিমধ্যে কঠোর নির্দেশনা ব্যাংকের প্রত্যেক দপ্তরে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কারণ ৯৮তম ব্যাচে সিনিয়র অফিসার হিসেবে রূপালী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া মজিবুর রহমান ১১ নভেম্বর এমডি হিসেবে জনতা ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছেন। অন্যদিকে ৯৩ ব্যাচের জনতা ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা ডিজিএম থেকেই অবসরে যাচ্ছেন।
জানতে চাইলে জনতা ব্যাংকের মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের (এইচআর) প্রধান জেনারেল ম্যানেজার আব্দুল মতিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত সংবেদনশীল। তবে চাকরি যখন করছি, এখানে কাউকে ছোট-বড় করে দেখার সুযোগ নেই। আপনিও আমার চেয়ার বা ওপরের চেয়ারে বসলে নির্দেশ মানতে বাধ্য। পাদায়ন এবং পদোন্নতি সরকারের সিদ্ধান্ত, তাই চাকরি করলে মানতেই হবে।
তার আগে জনসংযোগ কর্মকর্তা ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) কবি খলিল মজিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এ বিষয়ে এমডির নির্দেশনা ছাড়া গণমাধ্যমে কথা বলা নিষেধ।’ আরো তথ্য জানতে তিনি এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করতে অনুরোধ করেন।
তবে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মজিবুর রহমানকে নির্দিষ্ট দুটি বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে (টেক্সট) যোগাযোগ করা হলে কোনো সাড়া মেলেনি।
পদোন্নতি বৈষম্য নিয়ে সংবেদনশীল বিষয়ে জনতা ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে তাদের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে তারা ‘২০১৯ সালে আওয়ামী সরকারের গঠিত প্রজ্ঞাপন বাতিল’ দাবি জানিয়েছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন, সরকারি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও জিএম পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন নীতিমালার বিধান এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। যা আগে ছিল না। যে কারণে ২০১৯ সালের পরে ওপরের দিকে পদোন্নতি নেই। যার প্রভাবে নিচের দিকে এখন চাপ বাড়ছে। কোথাও কোথাও বিশৃঙ্খলাও শুরু হচ্ছে, কাজের পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে।
তারা বলেন, আগে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রত্যেক ব্যাংক নিজ নিজ যোগ্যতায় এমডি, ডিএমডি নিয়োগ ও পদোন্নতি দিতে পারত। ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার প্রজ্ঞাপন দিয়ে তা বাতিল করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার পছন্দের লোক নিয়োগ দিয়ে ব্যাংকের আমানত নামে-বেনামে তুলে নিতে পেরেছে। এখন সেই রীতির প্রজ্ঞাপন বন্ধ করা হোক।
২০০৫-০৬ সালের দিকে রূপালী ব্যাংক বিক্রির আলোচনা হয়েছিল। এ নিয়ে সে সময়কার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে আনুষ্ঠানিক উদ্যোগও নেওয়া হয়। তাতে সে সময় অনেকে ব্যাংকটির চাকরি ছেড়ে দেন। তাতে শূন্য পদে দ্রুত পদোন্নতি পান ব্যাংকটির অনেক কর্মকর্তা।
এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটির (বিআরসি) মাধ্যমে ১৯৮৮, ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে এমডি হয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে ১৯৯৮ সালের ব্যাচে সিনিয়র অফিসার হিসেবে রূপালী ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া মজিবুর রহমান এখন জনতা ব্যাংকের এমডি। আর অন্য ব্যাংকে একই ব্যাচে নিয়োগ পাওয়া অনেকে এখনো উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) পদে রয়েছেন।
এখন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জিএম পদোন্নতির সিদ্ধান্তে রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তারাই বেশি লাভবান হবেন। কারণ, তারা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অন্য ব্যাংকের শূন্য পদে পদায়নের সুযোগ পাবেন। বিআরসির অধীনে নিয়োগের সময় কর্মকর্তারা কর্মস্থল হিসেবে পছন্দের তালিকায় একেবারে শেষে রাখতেন রূপালী ব্যাংককে, শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
আপনার মতামত লিখুন :