জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক চুন্নু কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে পাঁচবারের এমপি। বিরোধী দলে থেকেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। গত দেড় দশকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে জাতীয় পার্টির দায় সবচেয়ে বেশি বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
জানা যায়, একসময় চাঁদা তুলে নির্বাচন করেছিলেন জাপা নেতা চুন্নু। পরবর্তীতে হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, অর্থপাচার করে বিদেশে বাড়ি কিনেছেন।
প্রতিবার নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা খরচ করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। অভিযোগ, গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগের কাঁধে ভর করে ক্ষমতার সবটুকু স্বাদ নিয়েছেন চুন্নু। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় একাধিক মামলার আসামি এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকলেও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিট এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা তাদের নানা অপরাধ-অপকর্ম, দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। যদিও তালিকায় নাম নেই স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের অন্যতম দোসর জাতীয় পার্টির নেতাদের। তারা রয়েছেন বহাল তবিয়তে, পট পরিবর্তনের পর মুজিবুল হক চুন্নু এবং জাতীয় পার্টির নেতারা ভোল পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছেন। যদিও ছাত্র-জনতা তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। জাতীয় পার্টিকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করার জন্য আন্দোলন করছে। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তাদের দাবিকে অযৌক্তিক বলে শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে কথাও বলেছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব। গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের সব ধরনের বিপদে-আপদে পাশে ছিলেন দলটির দ্বিতীয় শীর্ষ এই নেতা।
কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনটি জাতীয় পার্টির শক্তিশালী কোনো অবস্থান না থাকলেও জোটের কারণে আসনটি ছাড় দিয়েছে বারবার আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ব্লাকমেইল করে আওয়ামী লীগের এজেন্ট হয়ে নির্বাচনে যেতে বাধ্য করতেন বলে খোদ দলটির নেতাকর্মীদের অভিযোগ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমলে এবং বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরকে ব্যবহার করে জাতীয় পার্টির কমিটি ও পদ বাণিজ্য করে অর্থ রোজগার করার অভিযোগ রয়েছে চুন্নুর বিরুদ্ধে। প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বা জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নেওয়া এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার বিনিময়ে চুন্নু বারবার এমপি হয়েছেন, হয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। বিরোধী দলে থেকেও সরকারের প্রতিমন্ত্রী হওয়ার বিরল ঘটনাও ঘটান চুন্নু। রাজনৈতিক মহলের মত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কাছ থেকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন চুন্নু।
মূলত, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করে একাধিক নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর হয়েছেন সংসদ সদস্য। রাতের ভোট, বিনাভোট, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনে এমপি হওয়ার সুযোগ পেয়ে ক্ষমতার পুরো স্বাদ নিয়েছেন। ক্ষমতায় থাকাকালীন পুরো সময়ে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর অবৈধ অর্থ উপার্জন করে বনে গেছেন টাকার কুমির। এক সময় সংকটে থাকলেও আওয়ামী লীগের পাশে থাকা জাতীয় পার্টির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মুজিবুল হক চুন্নুও সম্পদ অর্জনে অনেক এগিয়ে গেছেন। হলফনামার বাইরে স্বজনদের নামে দেশে-বিদেশে সম্পদ গড়ে তুলেছেন। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করে উঠে এসেছে এমন তথ্য। বিশ্লেষকেরা বলছেন রাজনীতিবিদদের সম্পদ কীভাবে এত বেড়ে যায় তা যেমন জনগণ ওয়াকিবহাল নয়, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও এর তথ্য বের করার চেষ্টা করা হয় না কখনো। এটা শুধু কাগজেই বিদ্যমান। এটা খুবই দুঃখজনক। সরকারি যেসব সংস্থা আছে, দুদক এটা খুঁজতে পারে, এনবিআর আছে তারা এটা খুঁজতে পারে। আমাদের ব্যাংক সেক্টর খুঁজতে পারে। সুতরাং প্রত্যেকটা সেক্টর যদি হলফনামা নিয়ে কাজ করে, তাহলে এগুলো গোপন করতে পারবে না।
গত ১৫ বছরে কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৭ কোটি টাকার। নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকা বেড়েছে ৩৭ গুণ। আর তার স্ত্রীর বেড়েছে প্রায় চার গুণ।
হলফনামা অনুযায়ী, চুন্নুর বর্তমান পেশা আইনজীবী, পাশাপাশি রয়েছে ব্যবসা। ২০০৮ সালে তার পেশা ছিল কেবল আইনজীবী। তবে সে সময় তার একটি বাস ছিল। ২০০৮ সালে মুজিবুল হক চুন্নুর পৈতৃক বাড়ি ছাড়া নগদ ও ব্যাংকে জমা অর্থ এবং বিভিন্ন অস্থাবর সম্পদ মিলিয়ে মোট ৪৪ লাখ ৪২ হাজার ২৯০ টাকার সম্পদ ছিল।
২০২৩ সালে হলফনামায় দেখা যাচ্ছে, চুন্নুর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ৪ কোটি ৭২ লাখ ৬৯ হাজার ৯১৭ টাকার। এ ছাড়া আছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা দামের গাড়ি। আর স্থাবর সম্পদ মোট ১ কোটি ৫৮ লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ টাকা মূল্যের জমি।
এদিকে ২০০৮ সালে তাঁর স্ত্রীর নগদ, ব্যাংকে রাখা অর্থ ও সঞ্চয়পত্র মিলিয়ে ১৯ লাখ ৯ হাজার ৯৩৩ টাকা এবং টঙ্গীতে ৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা মূল্যের ৫ কাঠা জমি ছিল। আর বর্তমানে তা বেড়ে ২ কোটি ৮৪ লাখ ৮৪ হাজার ৭৬০ টাকা এবং ২৯ ভরি স্বর্ণালংকার। এ ছাড়া রাজধানীতে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের ১৫ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং ৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা মূল্যের একটি প্লট আছে তাঁর নামে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি ও প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে নির্বাচনি এলাকায় উন্নয়ন কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং প্রকল্প শেষে উদ্বোধন করতেন। তবে উন্নয়ন কাজ থেকে কমিশন নিতেন তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী (এপিএস) আমিরুল ইসলাম খান বাবলু। বাবলু আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য হলেও চুন্নুর বিশ্বস্ত ছিলেন। করিমগঞ্জ ও তারাইল উপজেলার যত দুর্নীতি হয়েছে তার সব হয়েছে বাবুলের হাত ধরে। জাতীয় পার্টির মহাসচিবের এপিএস আওয়ামী লীগ নেতা বিষয়টি কিশোরগঞ্জে ছিলো মুখরোচক ঘটনা।
গত ১৫ বছরে চুন্নুর নির্বাচনী এলাকার প্রকল্পের কাজের ভাগবাঁটোয়ারা, নিজস্ব ঠিকাদারকে টেন্ডার পাইয়ে দেওয়া, বিশেষ প্রকল্প বণ্টন, কৃষি যন্ত্রপাতি ও কৃষিসংশ্লিষ্ট প্রকল্প, টিআর-কাবিখা, ৪০ দিনের কর্মসৃজনসহ বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতি ছিল ওপেন সিক্রেট। বাবলু সমস্ত কাজের টাকা পৌছে দিতেন চুন্নুর গোপন ঠিকানায়। এক সময়ের ক্ষমতাধর এপিএস বাবলুও কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।এমপি হওয়ার শুরুটা মোটেই সুখকর ছিল না চুন্নুর। ১৯৮৬ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচনে ভোট ডাকাতির আশ্রয় নেন বলে জানান তখনকার প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাড়াইলে ভোট ডাকাতি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হন চুন্নুর ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম। এরপর প্রতিটি নির্বাচনেই তিনি এর স্বাক্ষর রেখেছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে চুন্নুর কপালে ভাঁজ পড়ে। এ আসনে তখন আওয়ামী লীগের একাধিক প্রভাবশালী প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন।
প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিযোগ, এ অবস্থায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে মোটা অঙ্কের টাকা ঢেলে কোনো রকমে নির্বাচিত হন তিনি। হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি আর এলাকায় আসেননি। এখন তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এলাকাবাসী। গত ২৫ আগস্ট করিমগঞ্জে চুন্নুকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে ঝাড়ু ও জুতা মিছিল করেছেন তারা।
অভিযোগ অস্বীকার করে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবল হক চুন্নু রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা নিয়ে জাতীয় পার্টির অবস্থান সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলন করে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের বিস্তারিত জানিয়েছেন। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমার মতো একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাবেক বেঁচে থাকাবস্থায় তাকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে বা ব্লাকমেইল করে নির্বাচনে নেওয়ার ক্ষমতা আমার ছিল না। সে সময় রওশন এরশাদ নেতৃত্বে এরশাদ সাবেক শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক করে এবং নির্বাচনে যায়। পরবর্তীতে এরশাদ সাহেবও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উপদেষ্টা হন।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, একাধিকবার সংসদ সদস্য ছিলাম। এ সময় প্রায় তিন কোটি টাকা বেতন পেয়েছি। দুইবার শুল্কমুক্ত ব্যবহার শেষে দেড় কোটি করে তিন কোটি টাকা লাভ করেছি। ২০০৮ সাল থেকে আইন পেশায় কর্মরত, সেখান থেকে রোজগার করেছি। নির্বাচনি হলফনামা এবং বার্ষিক ট্যাক্স ফাইলে সম্পত্তির যে হিসাব দিয়েছি এর বাইরে দেশে ও দেশের বাইরে আমার কোনো সম্পদ নেই। আমার সম্পদ দুদক তদন্ত করে বের করুক। দোষী হলে শাস্তি পাব।
এপিএস বাবলু সম্পর্কে জাতীয় মহাসচিব বলেন, আমার মামাতো ভাই হিসেবে বাবলু এপিএস ছিল। তার সঙ্গে মিলে দুর্নীতির প্রশ্নই উঠে না।ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের মামলা।
প্রসঙ্গে মুজিবুল হক বলেন, ৫ আগস্টের পর আমার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। ইতিমধ্যে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও আমি আইন উপদেষ্টা এবং স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছি, সেখানে মিথ্যা মামলার বিষয়ে বলেছি। দুই উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, এসব মামলা সরকার করেনি। কে বা কারা করেছে সেটি বিষয় নয়, প্রতিটি মামলা তদন্ত করা হচ্ছে, প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। মিথ্যা মামলায় কাউকে হয়রানি করা হবে না বলেও সরকারের পক্ষে দুই উপদেষ্টা জাতীয় পার্টিকে আশস্ত করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :