২৭ বছরেও আলো ছড়ায়নি ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্প। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এই প্রকল্প। ১৯৯৭ সালে ৩৮১ দশমিক ১১ একর জমিতে প্রকল্পটি গড়ে ওঠে। অবকাঠামো উন্নয়নে দীর্ঘসূত্রতা প্রকল্পটির আজকের এই অবস্থা। একনজর দেখলে বোঝা যাবে, সুবিশাল প্রকল্পটির অস্তিত্বটুকুই শুধু টিকে আছে। চারদিক বিরানভূমি, জনমানবহীন। হাতে গোনা বাড়িঘর। আর কেবলই ঝোপজঙ্গলে ভরা।
ফলে গোটা প্রকল্পে নিরপত্তার সংকট প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছিনতাই-রাহাজানি, দস্যুতা ও খুন-খারাবি প্রকল্পটিকে এখন ঘিরে ধরেছে। শুধু পাসপোর্ট অফিস ছাড়া গড়ে ওঠেনি অন্য স্থাপনা। তাই ঝিলমিলকে চেনাই দায়। ৪ ডিসেম্বর সরেজমিনে গিয়ে ঝিলমিলের নানা অব্যবস্থা চোখে পড়ে। সকাল থেকে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী ঘুরে সূচনালগ্নে ঝিলমিলের নামডাক রীতিমতো হতাশাব্যঞ্জক মনে হয়েছে।
প্রথমেই ১ নম্বর সেক্টরে গিয়ে দেখা যায়, চারদিক ধূ-ধূ। কোথাও কোনো ঘরবাড়ি নেই। যেদিকে চোখ যায়, কেবলই ঝোপঝাড়। একদিকে সারিবদ্ধ বিদ্যুতের খুঁটি পোঁতা। আর কিছুই নেই। সুয়ারেজ, পানি ও গ্যাসের অস্তিত্ব নেই। সরবরাহ লাইনটিও স্থাপিত হয়নি। চোখে পড়ে, পাশের মরে যাওয়া বুড়িগঙ্গা আর লোকালয়। প্রকল্পের ভেতরে গ্রামের ছেলেদের ফুটবল খেলা দেখা গেল। কানে এলো তাদের হইচই। এক কোণে দুটি চায়ের দোকান এবং সনাতনীদের চণ্ডীমায়ের অর্ধনির্মিত মন্দির। বলতে গেলে, এই দোকান আর মন্দিরই প্রকল্পের ১ নম্বর সেক্টরকে জীবন্ত করে রেখেছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা হলো মন্দিরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা তিমির দক্তের সঙ্গে।
জানালেন, এই প্রকল্পের সব প্লটই ৩ কাঠা আয়তনের। বেশ কয়েকজন প্লট-গ্রহীতা প্লট বিক্রি করে চলে গেছেন। প্রায় প্রতিদিনই বেচাকেনার খবর আসছে। তিমির জানালেন, একটি বটগাছকে কেন্দ্র করে মন্দিরের উৎপত্তি। বটগাছে চণ্ডীমায়ের নামে মানত করে অনেকেই ফল পেয়েছেন। তৎকালীন রাজা লক্ষীনারায়ণ এই অলৌকিকতায় মুগ্ধ হয়ে স্থায়ী মন্দির গড়ার জন্য ১১ কাঠা জমি দান করেন। প্রকল্পের জন্য রাজউক এটি উচ্ছেদ করে দখল নিতে এসে বারবার ব্যর্থ হয়।
উচ্ছেদকারী দলের প্রায় সবাই অসুস্থ হয়ে পড়লে রাজউক বাধ্য হয়ে জমিটি তাদের বুঝিয়ে দেয়। স্থানীয় হিন্দু-মুসলিমের সমন্বিত অর্থায়নে মন্দির চলে। বাৎসরিক মাহফিলে হিন্দু-মুসলিমের ঢল নামে। এখন সেখানে হিন্দুরা যেমন আসে, তেমনি মুসলিমরাও কম যায় না। তিমির বললেন, পাশেই তাদের আরও একটি ৫ কাঠার প্লট আছে। রাজউক এখনো এটির ফায়সালা করেনি।
২ নম্বর সেক্টরে ঢোকার মুখেই দেখা হলো এক প্লট-গ্রহীতার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মীরা সঙ্গে। আর কোনো চৌকিদার চোখে পড়ল না। নির্মীয়মাণ হীরা সাহেবের বাড়ির কর্মী তিনি জানিয়ে বলেন, এই ২ নম্বর সেক্টর বলতে গেলে অরক্ষিত। ছিনতাই, দস্যুতা, খুন-খারাবি এখানকার প্রাত্যহিকতা। দিনে-দুপুরেই ছিনতাই হয়। প্রতিদিনই খুন-খারাবি হয়।
অদূরে ব্রিজের কাছে অহরহ ছিনতাই হয়। কদিন আগে বিদ্যুৎ অফিসের এক কর্মীকে কুপিয়ে মোটরবাইক নিয়ে গেছে দস্যুরা। তিনি জানালেন, ব্রিজের পাশেই রাজউকের আনসার ক্যাম্প। কিন্তু তাদের কোনো তৎপরতা নেই। পুলিশ, র্যাব মাঝে মাঝে টহল দিয়ে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তারা চলে গেলে আবার অপরাধ হয়।
পুরো সেক্টর ঘুরে হাতে গোনা কয়েকটি নির্মীয়মাণ বাড়ি চোখে পড়ল। প্রবেশমুখ থেকে কয়েক গজ দূরে বিদ্যুতের সাব-স্টেশন। একেবারে সামনের দিকে পাসপোর্ট অফিস। এর পাশে একটি ছয়তলা ভবন। জানা গেল, এখানে একটি সিকিউরিটি এজেন্সির কার্যালয় চলমান।
সাব-স্টেশনের কর্তব্যরত বিদ্যুৎকর্মী জানালেন, বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য ঝিলমিল প্রকল্প প্রস্তুত। যেকোনো প্লট-গ্রহীতা চাইলেই সংযোগ নিতে পারবেন। স্টেশনের পাশ দিয়েই মাটি খুঁড়ে ওয়াসা বসিয়েছে পানির পাইপ। সুয়ারেজের কোনো হদিস মিলল না।
উপস্থিত লোকজন বললেন, সুয়ারেজের কাজ হাতেই নেওয়া হয়নি। স্বীকার করলেন প্রকল্প পরিচালক আমিনুর রহমান সুমনও। জানালেন, সুয়ারেজের কাজ শিগ্গিরই শুরু হবে।
সাবির্কভাবে বলা যায়, ধীরলয়ে হলেও প্রকল্পে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ এগোচ্ছে। ওয়াসার দুটি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে। প্রকল্পের ভেতরে বাইরের রাস্তা, কালভার্টসহ ভূমি উন্নয়নের কাজ পুরোপুরি শেষ। বেশ কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সেখানে গড়ে উঠবে স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল।
প্রকল্পের ইতিবৃত্ত ১৯৯৭ সালে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের গোড়াপত্তন। দফায় দফায় সময় বাড়ানো হলেও শেষ করতে না পেরে তৎকালীন রাজউক চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান ২০১৮ সালে এই ল্যান্ড প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এরপর দ্বিতীয় দফা জিডিপি করে বিদ্যুৎ-পানিসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। ৩৮১ দশমিক ১১ একর জমিতে গড়ে ওঠা প্রকল্পের মোট প্লটের সংখ্যা ১ হাজার ৭৭৪। বরাদ্দ হয়ে গেছে সব ক’টিই।
এরই মধ্যে অর্ধেক প্লট-গ্রহীতাকে প্লট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। শতাধিক গ্রহীতার নকশা অনুমোদন করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য
ঝিলমিল ল্যান্ড প্রকল্পের পরিচালক আমিনুর রহমান সুমন বললেন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ সব স্থাপনাই শিগ্গির গড়ে উঠবে। কেরানীগঞ্জ মডেল থানাকে প্রয়োজনীয় প্লট বরাদ্দ করা হয়েছে। সেখানে থানা গড়ে উঠলেই বর্তমান নিরাপত্তার সংকট কেটে যাবে।
আপনার মতামত লিখুন :