অর্থ পাচার-আত্মসাৎ ও দুর্নীতি করাসহ বিরোধী মত দমনে সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে যে ক’জন বেপরোয়া এমপি-মন্ত্রী ছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কামরুল ইসলাম বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে খাদ্যমন্ত্রী এবং আইন ও সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বেপরোয়া বনে যান তিনি।
বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, মামলা-হামলা, বিরোধীদল-মত দমন, সংবাদপত্রের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ, সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ, বিচারের নামে রাজনৈতিক হত্যা, অর্থ পাচার-আত্মসাৎ, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, গণহত্যা ও প্রপাগান্ডার সবকিছুর পেছনে আরেক ‘মাস্টার মাইন্ড’ ছিলেন এই কামরুল। গম চুুরিসহ নানা অপকর্মে তিনি ‘গমরুল’ নামেও পরিচিতি পেয়েছেন।
প্রায় তিন মাস আত্মগোপনে থাকার পর গত সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে সাবেক এ মন্ত্রীকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড আবেদনে পুলিশ বলেছে, কামরুল ইসলাম ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মর্মে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ঘটনার মূল রহস্য উদ্ঘাটন, ঘটনার পেছনে আর যারা জড়িত তাদের শনাক্তকরণ ও পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য রিমান্ডে নিয়ে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।
রিমান্ড আবেদনে আরও বলা হয়েছে, কামরুল ইসলাম চার বারের এমপি, একবার মন্ত্রী ও একবার প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। বিরোধী দলকে দমনের জন্য তিনি সব সময় আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি, অর্থ পাচার করেছেন। বিগত সরকারের আমলে এমন কোনো অপরাধ নেই যা তিনি করেননি।
এদিকে আদালতে হত্যা মামলার রিমান্ড শুনানিকালে কামরুল বলেন, ‘এই দিন দিন না, আরও দিন আছে। সব দিন তো একরকম যায় না। সামনে ভালো দিন আসবে’। এছাড়া রিমান্ড শুনানির সময় সাবেক মন্ত্রী কামরুলকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময়ের জেরে ঢাকা মহানগর আদালতের নাজির শাহ মো. মামুনের কার্যালয়ে হামলা ও ভাংচুর করেছে বিক্ষুব্ধ আইনজীবীরা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর আত্মগোপনে যান আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের দমনে পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ক্ষমতার দম্ভ ধরে রাখতে গিয়ে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হত্যা করা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার নারী, শিশু ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে। গুরুতর আহত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, পাবনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সেসব সন্ত্রাসীর অস্ত্রসহ ছবি ও ভিডিও তখনই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, প্রকাশিত হয় দেশের গণমাধ্যমগুলোতেও।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গুলি করে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাবেক মন্ত্রী-এমপি, পুলিশ সাংবাদিকসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নিউমার্কেটের ১ নম্বর গেটের সামনে গুলিতে নিহত ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদের শ্যালক আব্দুর রহমান বাদী হয়ে গত ২১ আগস্ট নিউমার্কেট থানায় একটি মামলা করেন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। অবশ্য অভ্যুত্থানের পরপরই আত্মগোপনে চলে যান কামরুল।
অভিযোগ রয়েছে আইন ও বিচারবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বিচার বিভাগ ও উচ্চ আদালতের কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করেছেন কামরুল ইসলাম। নিম্ন আদালতে অধিকাংশ কর্মচারীর নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে’ কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিতেন তিনি। তার নিজের নামে রাজধানীতে রয়েছে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও বেশ কয়েক কাঠা জমি। তিনি নিজ নামে ও সন্তানদের নামে দেশে-বিদেশে গড়েছেন ‘অঢেল সম্পদের’ পাহাড়। এ ছাড়া খাদ্যমন্ত্রী থাকাকালে ব্রাজিল থেকে নিম্নমানের গম কিনে আত্মসাৎ করেছেন সরকারের কোটি কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, তার সংসদীয় আসন ঢাকা-২ (কেরানীগঞ্জ ও কামরাঙ্গীর চর) এলাকায় নামে-বেনামে গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশতাধিক আবাসিক প্রকল্প চলত তার ছত্র ছায়ায়। আর এসব প্রকল্প থেকে ১৫ শতাংশ মাসোয়ারা পেতেন তিনি। কেউ জমি বিক্রি করতে না চাইলে তার পেটুয়া মাস্তান বাহিনী দিয়ে ওইসব এলাকার সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অল্প মূল্যে জমি কিনে নিত হাউজিংগুলো। আর এর বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা যেত কামরুলের পকেটে।
অবৈধ পথে দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদ কামরুলের: সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম দায়িত্বে থাকার সময় ব্রাজিল থেকে নিম্নমানের গম আমদানি করে সরকারের বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার নিজের নামে রাজধানীতে রয়েছে বাড়ি, ফ্ল্যাট ও বেশ কয়েক কাঠা জমি। আরও আছে দুটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি। এ ছাড়াও নিজের নামে ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন বলে দুদকের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। দুদক সূত্র জানায়, কামরুল ইসলাম আইন প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে নিম্ন আদালতে কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকার ঘুষ নিয়েছেন। খাদ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ব্রাজিল থেকে নিম্নমানের গম আমদানি করে সরকারের বিপুল টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
তার নিজের নামে রাজধানীর ৪৮/১ নম্বর আজগর লেনে একটি চারতলা বাড়ি, মিরপুর আবাসিক এলাকায় দুটি ফ্ল্যাট, মিরপুর হাউজিং এস্টেটে ৪ কাঠা জমি, নিউ টাউনে ১০ কাঠা জমি, দুটি টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার গাড়ি (নম্বর-ঢাকা মেট্রো-ঘ, ১৫-৭৭০৭ এবং ঢাকা মেট্রো-ঘ, ১২-১৪৩৫) রয়েছে।
কামরুল ইসলাম নিজ ও তার স্ত্রী-সন্তানদের নামে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। এ ছাড়া তিনি ও তার অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নামে-বেনামে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন।
জানা গেছে, গত ১৫ বছরে কামরুল ইসলামের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে প্রায় ৫৫ গুণ। তিনি প্রথম এমপি হন ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে। তখন তার বার্ষিক আয় ছিল চার লাখ ৬৫ হাজার টাকা। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৩১ লাখ টাকার বেশি। অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া, আইন পেশা, ব্যাংক সুদ, টেলিভিশনের টক শো, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানী থেকে তার এই আয় হয়। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে কামরুলের কোনো গাড়ি ছিল না। এখন তার দুটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি (নম্বর-ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৭৭০৭ এবং ঢাকা মেট্রো-ঘ ১২-১৪৩৫) রয়েছে। গাড়ি দুটির দাম প্রায় দুই কোটি টাকা। ১৫ বছর আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কামরুলের ছিল তিন লাখ ৮৮ হাজার টাকা আর তার স্ত্রীর নামে ছিল ১০ হাজার টাকা। বর্তমানে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে কয়েক কোটিতে।
কেরানীগঞ্জে আবাসন বাণিজ্যে ১৫ শতাংশ কমিশন: শেখ হাসিনার সরকার আমলে ঢাকার কেরানীগঞ্জে নামে-বেনামে গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশতাধিক আবাসিক প্রকল্প, যার একটিরও অনুমোদন নেই। এ সুযোগে কমিশন বাণিজ্যের নামে কামরুল বানিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নসহ মূল ঢাকা শহরের কাছে হওয়ায় কেরানীগঞ্জে জমির চাহিদাও বেড়েছে, নজর পড়েছে আবাসন ব্যবসায়ীদের। ফলে আবাসিক প্রকল্পের জমি কেনাবেচায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা কমিশন নিয়েছেন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। এর মধ্যে কামরুল পেয়েছেন ১৫ শতাংশ। এভাবে গত ১৫ বছরে তারা মিলেমিশে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আবাসন প্রকল্পে কমিশন আদায়, স্থানীয়দের জমি দখল, বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, মাদকের ব্যবসা, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে তার ছিল মোটরসাইকেল বাহিনী। এ ছাড়া তিনি নতুন সংগঠন বানিয়ে চাঁদাবাজি করতেন। কর্মীদের দলীয় পদ দিয়ে কামরুল ইসলাম নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। স্থানীয় চাঁদাবাজি শক্তিশালী করতে পছন্দের লোকদের নিয়ে পৃথকভাবে তৈরি করেন কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগ। কেরানীগঞ্জ উপজেলা সৃষ্টির পর থেকে আওয়ামী লীগের কমিটি ছিল অবিভক্ত। সেই কমিটির সর্বশেষ আহ্বায়ক ছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। কিন্তু ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে থানাভিত্তিক (দুই থানায় দুই কমিটি) কেরানীগঞ্জ মডেল থানার আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এতে আহ্বায়ক ইউসুফ আলী চৌধুরী সেলিম ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে শফিউল আজম খান, জিনজিরা ইউপি চেয়ারম্যান হাজি সাকুর হোসেন সাকু ও আলতাফ হোসেন নির্বাচিত হন। অন্যদিকে শাহীন আহমেদকে আহ্বায়ক ও ম ই মামুনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। এরপর ২০২২ সালের এপ্রিলে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ইউসুফ আলী চৌধুরী সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক আলতাফ হোসেন বিপ্লবকে নির্বাচিত করা হয়। তারা দুজনই ছিলেন কামরুলের বিশ্বস্ত সহচর। এই সময় সভাপতি-সম্পাদকসহ কেরানীগঞ্জ মডেল থানা আওয়ামী লীগের নেতারা কামরুলের ছত্রছায়ায় বৈধ-অবৈধ উপায়ে কামিয়েছেন শত কোটি টাকা। দখল করার অভিযোগ আছে ভূরি ভূরি। রাজধানীতে বহুতল ভবন, একাধিক ফ্ল্যাট ও কেরানীগঞ্জে বেনামেও রয়েছে শত শত একর জমি। স্থানীয় নেতাকর্মীরাও বানিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
আপনার মতামত লিখুন :