ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

শ্রমিক নেতা থেকে পরিবহন ‘সম্রাট’ শাজাহান খান

মেহেদী হাসান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪, ১২:২৮ এএম

শ্রমিক নেতা থেকে পরিবহন ‘সম্রাট’ শাজাহান খান

সাবেক এমপি শাজাহান খান। ছবি: সংগৃহীত

*পরিবহন খাত থেকেই টাকার কুমির 
*সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান ৭ দিনের রিমান্ডে 
*দেড় দশকে সম্পদ বেড়েছে ৫০ গুণ
*ক্ষমতার দাপট ও অবৈধপথে অঢেল সম্পদ
*তার ইশারায় পরিবহন খাত সচল ও অচল হতো

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানকে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি)। ৪ আগস্ট জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মোতালিব নামের এক কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

ওই ঘটনার জেরে ২৬ আগস্ট তার বাবা আব্দুল মতিন বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন। প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক নৌমন্ত্রী শাজাহান খানসহ ১৭৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এজাহারে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে শাহজাহান খানকে ৭ দিনের রিমান্ডে এনেছে পুলিশ। এদিকে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান দীর্ঘকাল ধরে ছিলেন দেশের পরিবহন খাতের মাফিয়া ডন। নিছক একজন শ্রমিক নেতা হয়ে উঠেন যেন পরিবহন সম্রাট। তার ইশারায় পুরো পরিবহন খাত চালু ও বন্ধ হতো। এই খাতে চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে বিগত ১৫ বছরে শাজাহান প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাজাহান খান মাদারীপুর-২ আসন থেকে টানা অষ্টমবারের মতো সংসদ সদস্য হন। এখনো তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। ছিলেন, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্য, অবস্থান এমনকি হাসির জন্য সমালোচিত হয়েছেন। ২০১৬ সালে পরিবহন খাতে নানা অনিয়মের জন্য তার অপসারণ দাবি ওঠে। এ ছাড়া ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর পর মন্ত্রীর মন্তব্য দেশের নানা জায়গায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণ হয়।

যেভাবে পরিবহন সেক্টরের ‘সম্রাট’ শাজাহান খান: রাজনীতির শুরুটা হয়েছিল আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মাঝে জাসদ হয়ে আবার ফিরেছেন আওয়ামী লীগে। হয়েছেন বড় নেতা ও মন্ত্রী। সড়কে দাপট শুরু হয়েছিল পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন দিয়ে।

সেখান থেকেই সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হয়ে এ খাতের সম্রাট হয়ে ওঠেন শাজাহান খান। এরপর থেকে শাজাহান ক্ষমতা, দাপট ও অবৈধপথে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। আর এই সুযোগে হয়ে যান প্রভাবশালী শ্রমিক নেতা। গত দেড় দশক থেকে তার সম্পদ বেড়েছে ৫০ গুণ। শাজাহান খান সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মাদারীপুর-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নবম ও দশম সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত শেখ হাসিনা সরকারের নৌমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়ী হলেও তাকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর দায়িত্বে ছিলেন শাজাহান খান। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতিও।

তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। চলতি বছর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া হলফনামায় তিনি আয় দেখিয়েছেন ২ কোটি ২১ লাখ টাকা। অর্থাৎ তার আয় বেড়ে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ গুণ হয়েছে।

তথ্যমতে, ২০০৮ সালে শাজাহান খানের অস্থাবর সম্পদ ছিল প্রায় ৫০ লাখের বেশি। এখন তা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় (আসবাব, ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ও বন্দুকের দাম বাদে)। অর্থাৎ তার অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ৫০ গুণ।

তথ্যমতে, মাদারীপুর-২ আসন থেকে ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন শাজাহান খান। একই আসন থেকে তিনি পরের নির্বাচনগুলোতেও প্রার্থী হন। তিনি পেশা হিসেবে রাজনীতি, সাধারণ ব্যবসা ও অন্যান্য উল্লেখ করেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখ করেন স্নাতক (পাস)।

হলফনামা অনুযায়ী, শাজাহান খানের দুটি গাড়ি রয়েছে, যার দাম ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এবার তার স্ত্রীর নামে ৮০ ভরি সোনা ছাড়া আর কোনো অস্থাবর সম্পদ দেখানো হয়নি। ২০০৮ সালে দুটি বাস, একটি গাড়ি ও একটি মাইক্রোবাস, ১৫ ভরি সোনাসহ প্রায় ৪১ লাখ টাকার সম্পদ দেখানো হয়েছিল।

‘শাজাহান খান ও তার স্ত্রীর বেশকিছু কৃষি ও অকৃষিজমি রয়েছে। তার প্রায় ৬ কোটি টাকার ভবন ও সমজাতীয় স্থাপনা রয়েছে। দানসূত্রেও ফ্ল্যাট ও জমির মালিক হয়েছেন তিনি। তার স্ত্রীর নামে রয়েছে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট ও অন্যান্য স্থাবর সম্পদ।’ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, শাজাহান খানের স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগমের মাধ্যমে তার অবৈধ অর্থের লেনদেন হতো। এ ছাড়া তার আরেক ভাই হাফিজুর রহমান খানও অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন।

সূত্র জানায়, শাজাহানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সার্বিক কনস্ট্রাকশন, সার্বিক শিপিং লাইন চট্টগ্রাম, সার্বিক ফুড ভিলেজ (সার্বিক হোটেল) সবকিছুই তার পরিবারের সদস্যদের নামে।

বিশেষ করে ঢাকা-মাদারীপুর রুটের সার্বিক পরিবহন কোম্পানিতে একক আধিপত্য তার। এ পরিবহনের ব্যানারে প্রায় ৩০০টির বেশি গাড়ি চলাচল করত। এ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন তার ছেলে।

জানা যায়, শাজাহান খানের স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগম একসময় একটি কলেজের প্রভাষক ছিলেন। তার জ্যেষ্ঠপুত্র আসিব খান আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং সর্বশেষ মাদারীপুরের সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। ছোট ছেলে মাহাদী খান সামস। একমাত্র মেয়ে ঐশী খানকে বিয়ে দিয়েছেন টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য (এমপি) তানভীর হাসানের (ছোট মনির) সঙ্গে। ঐশীকেও বাসের মালিকানা দেওয়া হয়। শাজাহান খানের এই পরিবহন সাম্রাজ্য শুরুতে চালাতেন তার চাচাতো ভাই পাভেলুর রহমান শফিক। একসময় তার সঙ্গে দ্বন্দ্বের পর ছোট ভাই ওবায়দুর রহমান খানকে (কালু) উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান এবং তার মাধ্যমে মাদারীপুর নিয়ন্ত্রণ করেন। সর্বশেষ তার নিজ বড় ছেলে আসিব খানকে মাদারীপুরের সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানান। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগে ছিল ব্যাপক ক্ষোভ।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শাজাহান খানের সার্বিক পরিবহনের ৩২টি বাসে আগুন দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের মতো তিনিও গা-ঢাকা দেন কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।

শাজাহান খানের ইশারায় পরিবহন খাত চালু ও বন্ধ হতো: শ্রমিক নেতা হিসেবে শাজাহান খানের উত্থান হয় ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হওয়ার মধ্য দিয়ে। ওই বছরই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক হন। এরপর ১৯৮০ সালে ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক ও ১৯৯৪ সালে কার্যকরী সভাপতি নির্বাচিত হন। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ায় শাজাহান খানের জন্য সড়কে চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ সহজ হয় ওঠে।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের এক শীর্ষ নেতা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাস মালিকদের জিম্মি করে রাখতেন শাজাহান খান। সড়কে চাঁদাবাজি কোনোভাবেই ঠেকানো যেত না। তখনকার বাস মালিক নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে পরিবহন খাতকে নাজেহাল করা হয়। ফেডারেশনকে শাজাহান তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করত। পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের জন্য দায়ীদের মধ্যে শাজাহান খান অন্যতম।

পরিবহন শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, শাজাহান খানের নির্দেশে পুরো পরিবহন খাত চলত। তার ইশারায় পরিবহন চালু ও বন্ধ হয়। পরিবহন শ্রমিকদের উন্নয়নে কোনো অবদানই ছিল না তার।

নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একাধিক শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা জানান, প্রতিদিন শাজাহানের নেতৃত্বে সড়ক থেকে ৫ কোটি ৬৫ লাখের বেশি টাকা (চাঁদা) তুলত ফেডারেশন। কিন্তু সেসব টাকা শ্রমিকদের কোনো কাজেই আসত না।

ওই শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ, শাজাহান খান তার ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলীকে নিয়ে সারা দেশে পরিবহন খাতকে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন।

কে এই শাজাহান: শাজাহান খান পাকিস্তান আমলে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন।

এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে শাজাহান খান জাসদের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলেও হেরে যান। এর ঠিক এক মাস পরই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং উপনির্বাচনে নৌকার প্রার্থী হয়ে মাদারীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এরপরের জাতীয় নির্বাচনগুলোতেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন।

শ্রমিক নেতা ও সিপিবির সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান খান বলেছেন, শাজাহান খানের বাবা আওয়ামী লীগের এমপি ছিলেন। জাসদের যখন খারাপ সময় আসে তখন আবার আওয়ামী লীগে চলে গিয়েছিলেন শাজাহান খান। তিনি বলেন, ‘ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্লাহকে নিয়ে সড়ক থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন শাজাহান খান। তার ছিল মাস্তান বাহিনী। তাদের বলয়ে তিনি প্রভাব দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা বানিয়েছেন।’

শাজাহান খান ৭ দিনের রিমান্ডে: কিশোর আব্দুল মোতালিবকে হত্যার ঘটনায় রাজধানীর ধানমন্ডি থানার মামলায় সাবেক নৌ ও পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। শুক্রবার (৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আহমেদের আদালত এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এদিন তাকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তার ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. খোকন মিয়া। এ সময় আসামিপক্ষে রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে শুনানি করা হয়। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এই বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, শাজাহান খান ছাত্র হত্যা মামলার আসামি ছিলেন। সেই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

আরবি/জেডআর

Link copied!