ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

ভারতের কূটনৈতিক শিষ্টাচারে ঘাটতি

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২৪, ১২:২৫ এএম

ভারতের কূটনৈতিক শিষ্টাচারে ঘাটতি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ধার ধারছে না ভারত। সম্প্রতি ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে ভারত তার প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক শিষ্টাচারে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যেটা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক শিষ্টাচার কেমন হবে, কী ধরনের সুবিধা পাবেন বা তাদের সঙ্গে আচরণ কেমন করা হবে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে আন্তর্জাতিক আইনে। সেটা ভারতেরও জানা রয়েছে। কিন্তু ভারত সেটা মেনে চলতে চরম ব্যর্থ হয়েছে। গোটা বিশ্ব তা দেখতে পাচ্ছে। 

জানা যায়, কূটনীতিকদের আচরণ বিষয়ে একটি চুক্তি ১৯৬১ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্ব নেতাদের অংশগ্রহণে সই করা হয়েছিল এবং সেটি ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন হিসেবে পরিচিত। চুক্তিটিতে ৫৩টি ধারা রয়েছে। স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো চুক্তি অনুযায়ী তা মানতে বাধ্য। তবে কোনো দেশ চুক্তি অনুযায়ী ওইসব ধারার পরিপন্থি কাজ করলে সেটা চুক্তি লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

চুক্তির সূত্র জানায়, একটি দেশে অন্য দেশের দূতাবাস কেমন হবে এবং সেটির নিরাপত্তায় স্বাগতিক দেশ কী ধরনের ব্যবস্থা নিবে, সে বিষয়ে ভিয়েনা চুক্তিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, প্রেরক দেশের দূতাবাসের জন্য জায়গা বরাদ্দের পাশাপাশি সেখানে কর্মরত কূটনীতিকদেরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয় স্বাগতিক দেশকে।

এক্ষেত্রে নিরাপত্তা এতটাই সুরক্ষিত থাকে যে, ভূমি বরাদ্দ দেওয়ার পর বিদেশি মিশনপ্রধানের অনুমতি ছাড়া স্বাগতিক দেশের সরকার বা তাদের কোনো প্রতিনিধিও সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন না। ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস’ চুক্তির ২২ নম্বর ধারায় বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে সম্প্রতি ভারত তার প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক শিষ্টাচারের চরম ব্যর্থতা দেখিয়েছে। গত সোমবার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠন হামলা চালায়। 

যেখানে ভিয়েনা চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল নিয়ম-নীতি অনুসরণের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়ন করা। সেখানে ভারত বরাবরই তাদের নিকৃষ্ট আচরণ করে প্রমাণ করছে তারা কতটা শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশ। ভিয়েনা কনভেনশন চুক্তি রক্ষায় কতটুকু আন্তরিক ভারত তা নিজেদের কার্যকলাপে বুঝিয়ে দিয়েছেন তারা। যদিও মোদি সরকার বারবার আন্তর্জাতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে আসছে।

ভারতের ওপর এর আগেও ভিয়েনা চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল কানাডা সরকার। ভারত থেকে কানাডার ৪১ জন কূটনীতিককে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনায় ভিয়েনা কনভেনশনের শর্ত লঙ্ঘন হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে কানাডা।

যেখানে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা দেওয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ছিল ভারতের, সেখানে অভিযোগ উঠেছে পরিকল্পিতভাবে চালানো ওই হামলার সময় নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে ভারতীয় পুলিশ।

অথচ নিয়ম অনুযায়ী, হাইকমিশনের সীমানায় ঢোকার আগেই বিক্ষোভকারীদের আটকে দেওয়ার কথা। যেখানে অনুমতি ছাড়া সরকারের প্রতিনিধিই ঢুকতে পারে না, সেখানে এত মানুষ কীভাবে ঢুকে পড়ল? এমন প্রশ্ন বিশ্লেষকদের।

তথ্য মতে জানা যায়, কূটনৈতিক সম্পর্ক ও আচরণবিষয়ক চুক্তি ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশনস’ নামেও পরিচিত। তাতে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক, কূটনৈতিক শিষ্টাচার কিংবা সংকটকালে আচরণের সীমারেখা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।

বিশেষ করে চুক্তির ২২ নম্বর ধারায় বলা আছে, কূটনীতিক মিশনের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে স্বাগতিক দেশকেই। সেখানে কোনো ধরনের হামলা, ক্ষতি, শান্তি নষ্ট বা মর্যাদাহানি যেন না হয়, সে বিষয়ে স্বাগতিক দেশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ঢাকা-দিল্লির সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্ব দরবারে, ভারত এই শিষ্টাচার কতটা মেনে চলছে? বিশেষ করে ভারতের আগরতলার সহকারী হাইকমিশনে হামলার ঘটনার পর ভিয়েনা কনভেনশন চুক্তি রক্ষায় ভারত কতটুকু আন্তরিক ছিল, সে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্তৃত্ববাদী আচরণ কেবল প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কে তিক্ততা বাড়ায়। দুই দেশের সম্পর্ক হতে হবে স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে। গুজব, অপপ্রচার বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধি করবে এমনটাও সতর্ক করেছেন তারা।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রতিবেশী দেশের এমন অনাহূত আচরণে সংকট বাড়ছে দুই দেশের মধ্যে। একই সঙ্গে তারা মনে করিয়ে দিলেন, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে প্রত্যেকেরই আছে সমান দায়িত্ব।

এই বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেছেন, সহকারী হাইকমিশনে হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর আগে কলকাতায় উপ-হাইকমিশনে এমনটা হয়েছে। এর পরপরই তাদের উচিত ছিল, আগরতলা-দিল্লি অন্যান্য মিশনে নিরাপত্তা বাড়ানো। কিন্তু তা হয়নি। ভিডিও ফুটেজে আমরা দেখেছি, সেখানে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের শারীরিক অঙ্গ-ভঙ্গি এমন ছিল, যেন তারাই হামলার অনুমতি দিয়েছে।

নাঈম আশফাক চৌধুরী বলেন, একটা দেশের সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্পর্ক কেবল সরকারে সঙ্গে সরকারের হওয়া উচিত না। কিংবা একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আরেকটি দলের হওয়া উচিত না।  এটা হওয়া উচিত জনগণের সঙ্গে জনগণের। দুইটা প্রতিবেশীর সঙ্গে যে সম্পর্ক হবে, তা পারস্পরিক সহায়তা ও আত্মমর্যাদা বজায় রেখে হওয়া উচিত।

এদিকে ভারতের নানামুখী ষড়যন্ত্র, দেশটিতে অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলাসহ নানা অভিযোগের প্রতিবাদ হিসেবে গত ৮ ডিসেম্বর ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে পদযাত্রা করে বিএনপির তিন অঙ্গ সংগঠন যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল। পরে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়।

অন্যদিকে এসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) আহমেদ ফেরদৌস বলেন, বাংলাদেশের হাইকমিশনে আক্রমণ, ওইটা কিন্তু বাংলাদেশ। ধরে নিতে হবে তা বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ। ঢাকার বারিধারায় যে প্রতিবাদ কর্মসূচি ছিল, তা কিন্তু সরকার নিরাপত্তা দিয়ে ভারতীয় দূতাবাসকে রক্ষা করেছে। তাতে ভারত ও বাংলাদেশ কী দায়িত্ব পালন করেছে তা উঠে এসেছে।

তবে বিশ্লেষকদের দাবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রপচার কিংবা অপতথ্য না ছড়িয়ে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপস্থাপনে নজর দিতে হবে। আর না হয় বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!