ঢাকা শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

লাপাত্তা শেখ রেহানার ফান্ড ম্যানেজার নাসিম

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ১২:২৯ এএম

লাপাত্তা শেখ রেহানার ফান্ড ম্যানেজার নাসিম

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রটোকল অফিসার হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। সেই সূত্র ধরে ফেনী জেলার রাজনীতির একচ্ছত্র আধিপত্য তার। পুরো জেলায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা সাবেক এমপি নিজাম হাজারীর গডফাদার বলা হয় তাকে। এত সব পরিচয় ছাপিয়ে শেখ রেহানার ‘ফান্ড ম্যানেজার’ হিসেবে গত দেড় দশক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসহ মাদক ব্যবসা, নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, ঘুষ-চাঁদাবাজির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। কানাডাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছেন এই সাবেক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্য। নাসিমের হাত ধরে দেশের বেসরকারি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত, ঢাকায় মদের ব্যবসা এবং ফেনীতে অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘স্বর্গরাজ্য’ গড়েন। নানান অপকর্ম ও দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগ আমলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা একে একে ধরা পড়লেও এখনো বহাল তবিয়তে দুর্নীতির বরপুত্র খ্যাত আলাউদ্দিন নাসিম।

সূত্রমতে, বর্তমানে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আত্মগোপনে রয়েছেন। সেখান থেকে কানাডায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অন্যদিকে, নাসিমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। নাসিম ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে রয়েছে হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ। এ ছাড়া কানাডায় রয়েছে বাড়ি-গাড়ি। ফেনীর আরেক সাবেক এমপি নিজাম হাজারীর গডফাদার হিসেবে পরিচিত নাসিমের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে ছিল জেলার সন্ত্রাস, মাদক ও সীমান্ত চোরাচালান।

নাসিমের হাত ধরে দেশে গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের মহোৎসব চলেছে। শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বিনা পুঁজিতে ব্যাবসায়িক পার্টনার হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের প্রকল্প থেকে বিদেশে পাচার করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের ৩০ শতাংশ শেয়ারের মালিক ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। শুধু বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে শত শত কোটি টাকা লোন নিয়ে বিদেশে পাচার করেন তিনি। জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে ২০ পার্সেন্ট কমিশন না দিলে কোনো টেন্ডারই পেতেন না ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই তিনি বুঝে নিতেন তার কমিশনের টাকা। প্রভাবশালী এই সাবেক এমপিকে ব্যাবসায়িক পার্টনার বানিয়ে কোনো রকম টেন্ডার বা প্রতিযোগিতা ছাড়াই সরকারের কাছ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় বড় প্রকল্প বাগিয়ে নেন এক আলোচিত ব্যবসায়ী। তাকে বলা হয় দেশের অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী। ঢাকার অভিজাত গুলশান এলাকায় রয়েছে তার মদের গুদাম, যা সবচেয়ে বড় মদের গুদাম। ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব থেকে সদস্যদের জন্য কম দামে কেনা মদ তিনি বেশি দামে বিক্রি করেন বলে অভিযোগে রয়েছে।

সম্প্রতি একটি ভিডিওতে সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে কলকাতায় মাস্তি করতে দেখা যায় নাসিমকে। এর পরই নতুন করে আলোচনায় পতিত স্বৈরাচারের দোসর।

ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গুলি করে ১৩ জনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি। ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর ফেনীজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে নাসিম এখন কোথায়? ফেনীতে নাসিমের নামে তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে। আলাউদ্দিন নাসিমের নির্দেশেই ফেনীতে ছাত্র-জনতাকে গুলিতে হত্যা করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের নির্দেশে জুলাই ও আগস্ট মাসে ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালীতে চলে ছাত্র হত্যা। 

মেয়ে রাকা চৌধুরী এখনো কানাডায় অবস্থান করছেন। এমপি হওয়ার আগেও তিনি পরিবার নিয়ে প্রায়ই কানাডায় থাকতেন। তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সচিবালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২০ পার্সেন্ট কমিশন নিতেন আলাউদ্দিন আহমেদ।

এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মানুষের কৃষিজমি জিম্মি করে কাউকে দিয়েছেন স্বল্পমূল্য, আবার কেউ জমি লিখে দিতে না চাইলে সেই জমি তিনি দখল করে নিয়েছেন। ২০ বিঘা জমির ওপরে গড়ে তোলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুকুর রয়েছে চারটি। ফেনীর পরশুরামে ৩০ একর জায়গায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ।

স্থানীয়দের অভিযোগ, জোরপূর্বক ও ভয় দেখিয়ে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করে কলেজের জন্য কৃষিজমির জায়গা দখল করে নেওয়া হয়। এবার ফেনী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামে তার অনুসারীদের দিয়ে নানা কায়দা-কৌশল করে নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যান বানান। এ ছাড়া নির্বাচনি এলাকার বাইরেও অন্যান্য উপজেলায়ও তার অনুসারীদের চেয়ারম্যান বানান।

২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর কোনো পদে না থেকেও জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন নাসিম। পাশাপাশি প্রভাবশালী একজন আবাসন ব্যবসায়ীসহ বড় কয়েকটি ব্যাবসায়িক গ্রুপের স্বার্থরক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পাশাপাশি সাবেক সংসদ সদস্য মির্জা আজম, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, বাহাউদ্দিন নাছিম ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনকে নিয়ে একটা ছোট স্বার্থান্বেষী গ্রুপও তৈরি করেন।

অস্ত্র মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি নিজাম উদ্দিন হাজারীকে ২০১১ সালে ফেনী পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত করা এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক করার পেছনেও ছিলেন নাসিম।
আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) ইতিমধ্যে অভিযোগ জমা পড়েছে। গত ১৫ বছরে তিনি অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন ও পাচার করেছেন বলে এই অভিযোগে বলা হয়।

সম্প্রতি দুদকে জমা পড়া একটি অভিযোগ থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নাসিম হয়ে ওঠেন অঘোষিত গডফাদার। তার বিরুদ্ধে এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের জুলুম-নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, সাবেক এমপি নাসিমের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অর্থ-সম্পদের অভিযোগ করেছেন ফেনীর পশুরামের বাসিন্দা মঈন আহমেদ নামে এক ব্যক্তি। অভিযোগের ভিত্তিতে দুদক অর্থ-সম্পদের খোঁজ করছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় আলাউদ্দিন নাসিম ও তার স্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু ১০৮ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৫ টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৫৭ হাজার ২৯৫ টাকা এবং তার স্ত্রীর ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫০ টাকা। তবে বাস্তবে তারা হাজার কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে তাদের রয়েছে শত শত বিঘা জমি। ঢাকায় রয়েছে অসংখ্য ফ্ল্যাট ও বিলাসবহুল গাড়ি। একজন সরকারি কর্মকর্তা থেকে বনে গেছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক।

নাসিম ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৮৬ সালে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসে যোগ দেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা হওয়ার পর বাধ্য হয়ে চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রভাব বিস্তার করে সেই মামলা থেকে তিনি খালাস পান।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নাসিম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রটোকল কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলে তিনি বিরোধীদলীয় নেতার প্রটোকল কর্মকর্তা হন। পরবর্তী সময়ে তিনি সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। ২৩ বছরের চাকরিজীবনে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কামিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। তিনি কানাডার নাগরিক হওয়ার পরও হাসিনা তাকে এমপি নির্বাচিত করেন। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্যপদ পান তিনি। অবশ্য পরে তাকে বাদও দেওয়া হয়। কানাডা, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে তার ব্যবসা ও বাড়ি-গাড়ি।

আরবি/জেডআর

Link copied!