দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো বাণিজ্যিক সংগঠন থাকলেও এসব সংগঠনের সদস্যদের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে বেশি ব্যস্ত থাকেন নেতারা। সংগঠনগুলো কল্যাণমুখী করতে এবং নামসর্বস্ব নতুন সংগঠন গড়া ঠেকাতে ২০২৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ‘বাণিজ্য সংগঠন (সংশোধন) বিল, ২০২৩’ পাশ করা হয়েছে। এতে কঠিন হয়ে যায় বাণিজ্য সংগঠন গড়ার শর্ত। ফলে বিগত ১৪-১৫ বছরে যেভাবে বাণিজ্যিক সংগঠন গড়ে উঠেছে, তা এখন আর সম্ভব হচ্ছে না।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তা এখন আরও কঠিন হয়ে গেছে। এজন্য নতুন সংগঠন গড়ার থেকে দখলকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন সুবিধাভুগী নেতারা।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পুরোনো বিধিমালা সংশোধন করে নতুন বিধিমালা তৈরি করা হচ্ছে। কাজ শেষ হলেই সরকার গেজেট আকারে তা প্রকাশ করছে। এর বেশি তার পক্ষে বলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ তিনি কয়েক দিন হয় এই বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে আইনটিকে যুগোপযোগী করা হয়েছে, বিধিমালাও এখন সেরকমই হবে। আমরা অবশ্যই চাই যে নামসর্বস্ব কোনো বাণিজ্য সংগঠন যেন না থাকে।
জানা গেছে, তিন দশক পর আইনে সংশোধন করা হয়েছে। নতুন আইনে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক ৮০ জন থেকে কমিয়ে ৬৮ জন করা হয়েছে। নতুন আইনে অনেক শর্ত পূরণের কথা বলা হয়েছে, যা আগে ছিল না।
এর আগে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা, ১৯৯৪ কার্যকর ছিল, যা করা হয়েছিল ১৯৮৫ সালের বিধিমালা বাতিল করে। উভয় বিধিমালাই করা হয় ১৯৬১ সালের বাণিজ্য সংগঠন অধ্যাদেশের ভিত্তিতে। সেই অধ্যাদেশ বাতিল করে ২০২৩ সালে নতুন বাণিজ্য সংগঠন আইন পাশ করে সরকার। এ আইনের ভিত্তিতেই নতুন বিধিমালা হবে।
বিধিমালার খসড়া অনুযায়ী বাণিজ্য সংগঠন করতে অন্তত ১১টি সমজাতীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠানকে একত্রে নামের ছাড়পত্রের জন্য বাণিজ্য সংগঠন মহাপরিচালকের কাছে আবেদন করতে হবে। সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে লিমিটেড কোম্পানি, এক ব্যক্তির কোম্পানি ও অংশীদারি প্রতিষ্ঠান তিনটাই থাকতে পারবে। নামের ছাড়পত্রের মেয়াদ থাকবে ছয় মাস। বিদ্যমান বিধিমালায় প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা নেই। নামের ছাড়পত্র নেওয়া এবং এর মেয়াদ থাকার কথাও নেই। তিন-চারটি প্রতিষ্ঠান একত্র হয়েও লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারে।
খসড়ায় বলা হয়েছে, বর্তমানে দুই বা এর বেশি বাণিজ্য সংগঠন যদি একই উদ্দেশ্যে লাইসেন্স নেয়, তাহলে বাণিজ্য সংগঠনের মহাপরিচালক এগুলোর লাইসেন্স বাতিল করে একত্রীকরণের আদেশ দিতে পারবেন। কোনো বাণিজ্য সংগঠন বা এফবিসিসিআই একত্রীকরণের জন্য আবেদন করলেও এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন মহাপরিচালক।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারাণা করছেন, নতুন বিধিমালা হলে বাণিজ্য সংগঠন করা কঠিন হয়ে যাবে। বর্তমানে এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদ ৮০ জনের। এসব পদ আবার দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে জেলাভিত্তিক বাণিজ্য সংগঠন বা চেম্বার থেকে ৪০ জন পরিচালক হয়েছেন; বাকি ৪০ পরিচালক পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনের। তবে ৮০ জন পরিচালকের মধ্যে ৩৪ জন মনোনয়নের মাধ্যমে ভোট ছাড়াই পদ পান; বাকি ৪৬ জনকে সরাসরি সদস্যদের ভোটে জিতে আসতে হয়।
নতুন বিধিতে চেম্বার গ্রুপ থেকে ৩২ জন ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রপ থেকে ৩২ জন করে মোট ৬৪ জন পরিচালক এবং দুটি সংগঠন থেকে সরকার মনোনীত দু’জন করে চারজন পরিচালক অর্থাৎ, মোট ৬৮ জন পরিচালক নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের পর্ষদ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন বলেন, বিধিমালা তৈরির জন্য যেভাবে অংশীজনদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা করার কথা ছিল, সরকার তা করেনি। সরকারের উচিত ছিল ব্যাপক হারে আলোচনা করা এবং এই আলোচনার ভিত্তিতে যে ফলাফল বের হয়ে আস, তা নিয়ে ফের আলোচনা করা। তাহলেই একটি ভালো বিধিমালা করা সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, নতুন বিধিমালায় কিছু ভালো দিক রয়েছে, ব্যাপক আলোচনা করলে আরও ভালো ভালো বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হতো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী দেশে মোট বাণিজ্যিক সংগঠন রয়েছে ১২৫টি। এর মধ্যে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ও বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি একক সংগঠন হিসেবে আছে, যা সারা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এর বাইরে মেট্রোপলিটন চেম্বার রয়েছে সাতটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও গাজীপুরে।
ঢাকা জেলা চেম্বার রয়েছে ১৩টি গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও কিশোরগঞ্জে।
চট্টগ্রাম বিভাগে রয়েছে ১১টি চেম্বার কুমিল্লা, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে।
রাজশাহী বিভাগে রয়েছে ৮টি চেম্বার চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী ও সিরাজগঞ্জে।
খুলনা বিভাগে রয়েছে ১০টি চেম্বার খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, নড়াইল, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া, মাগুরা, মেহেরপুর, যশোর ও সাতক্ষীরায়।
বরিশাল বিভাগে রয়েছে ৬টি চেম্বার বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বগুড়া এবং ঝালকাঠিতে। সিলেট বিভাগে রয়েছে ৪টি চেম্বার সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে।
রংপুর বিভাগে রয়েছে সাতটি চেম্বার কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও লালমনিরহাটে।
ময়মনসিংহ বিভাগে রয়েছে ৪টি চেম্বার ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা ও শেরপুরে।
উপজেলা পর্যায়েও রয়েছে দুইটি চেম্বার একটি ভৈররব, অপরটি বিয়ানীবাজারে।
দেশে উইমেন চেম্বর রয়েছে ২১টি বাংলাদেশ উইমেন চেম্বর অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির বাইরেও রয়েছে বান্দরবন, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ফরিদপুর, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নরসিংদী, কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী, সুনামগঞ্জ, দিনাজপুর, নাটোর, খুলনা ও কক্সবাজারে।
বাংলাদেশে যৌথ চেম্বার রয়েছে ৩৬টি বাংলাদেশ-মিয়ানমার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ডাচ্-বাংলা চেম্বার অব কমার্স অন্ড ইন্ডাস্ট্রি, অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, নরডিক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, কুয়েত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, স্পেন-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-ভিয়েতনাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, জাপান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ল্যাটিন আমেরিকা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, কোরিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-ফিলিপাইন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-ফিনল্যান্ড চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ইউক্রেন-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, রাশিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, সুইজারল্যান্ড-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ব্রাজিল-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, কানাডা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-নরওয়ে চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-নাইজেরিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ, ফ্রান্স-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-কাতার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ইন্দোনেশিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ইটালি-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, লিবিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ফরেন ইনভেস্টমেন্ট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, ইস্টার্ন ইউরোপিয়ান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং বাংলাদেশ-নেপাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।
আপনার মতামত লিখুন :