ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

রাজনৈতিক প্রকল্পের নামে লুটপাট

রহিম শেখ

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০১:০৩ এএম

রাজনৈতিক প্রকল্পের নামে লুটপাট

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

হাজার কোটি থেকে লাখ কোটি টাকার প্রকল্পে বেশি মনোযোগী ছিল ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার। মোটাদাগে এ রকম ১০টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পগুলোর মোট ব্যয় বরাদ্দ ১ লাখ ৮৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর পরিকল্পনা কমিশন আগের সরকারের অধিকাংশ প্রকল্প পর্যালোচনা করে দেখা যায়, রাজনৈতিক বিবেচনায় লুটপাটের লক্ষ্য সামনে রেখে অনেক প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে। বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে এ রকম প্রকল্প নেওয়ার কী প্রয়োজনীয়তা ছিল এবং প্রকল্পগুলো যৌক্তিকভাবে নেওয়া হয়েছে কি না পর্যালোচনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রকল্পগুলো থেকে বড় অঙ্কের বরাদ্দ কাটছাঁট অথবা স্থগিত করা হতে পারে বলে জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।

 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) সূত্রে জানা যায়, চিহ্নিত ১০ প্রকল্পের একটি হচ্ছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হাইওয়ে ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট-১।

প্রকল্পটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের ১৫১ কিলোমিটারের মাত্র ২৮ কিলোমিটার চার লেন করার কথা বলা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা।

অর্থাৎ, প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয় প্রায় ৩০৬ কোটি টাকা। প্রকল্পের তথ্যমতে, দেশের অবকাঠামো নির্মাণের ইতিহাসে এত ব্যয়ে আর কোনো মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়নি। প্রকল্পটির পিইসি সভায় সভাপতিত্ব করেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠমো বিভাগের সাবেক সদস্য (সচিব) এমদাদ উল্লাহ মিয়া। 

তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়গুলো কমিয়েছি। মূল সড়ক নির্মাণের খরচে আমরা হাত দিইনি। যদি সেখানে কাটছাঁট করি, তাহলে রাস্তায় কোনো সমস্যা হলে আমাদের দোষ হবে।’

এ রকম আরেকটি প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত রেলপথ ডুয়েল গেজে রূপান্তর। এর ব্যয় চারগুণ বাড়িয়ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চার বছর পর একই লাইন নির্মাণে ৮ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা ব্যয় ধরেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ সহায়তায় ১০ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি অনুমোদন দিয়েছে একনেক।

প্রকল্পের ব্যয় বিভাজনে দেখা যায়, প্রকল্পটিতে রেললাইন স্থাপনে অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় আড়াই থেকে চারগুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে।

আইএমইডি সূত্র জানায়, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ সময়ে তাকে খুশি করতে ৫ হাজার ৬৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলে উড়ালসড়ক নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটি নিয়ে বরাবরই পরিকল্পনা কমিশন, পরিবেশবিদ, যোগাযোগ বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবার আপত্তি ছিল। তার পরও প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে আসার দুই সপ্তাহের মধ্যেই তাড়াহুড়ো করে অনুমোদন দেওয়া হয়।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চাঁদপুরের মতলববাসীর জন্য ৪ হাজার ১৭৪ কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নেন তৎকালীন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। পুরো পরিকল্পনা কমিশন সেখানে প্রকল্প নেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। তবু নিজের ক্ষমতাবলে প্রকল্প বাগিয়ে নেন প্রতিমন্ত্রী।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে আরও জানা গেছে, গত নির্বাচনের আগের একনেক সভায় ৮ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে তিনটি নতুন প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব দেয় স্থানীয় সরকার বিভাগ। এগুলো হলোÑ চট্টগ্রাম বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্ত ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প, রাজশাহী বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়নের সড়ক প্রশস্ত ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্প এবং নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলার গুরুত্বপূর্ণ পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয় যথাক্রমে ৩ হাজার ১১০ কোটি, ২ হাজার ৪০০ কোটি ও ২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। বিদেশি ঋণ পাওয়ার আশায় একনেক সভায় এসব প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বিদেশি অর্থায়ন খোঁজার কথাও জানায় একনেক কমিটি।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রেক্ষাপটে এ প্রকল্পগুলোও তেমন জরুরি ছিল না।

অন্যদিকে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকার মেট্রোরেলের লাইন-১ ও ৪১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার লাইন-৫ নর্দার্নের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে ৫৪ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার এমআরটি-৫ সাউদার্ন। এসব প্রকল্পেও অপচয়ের উপাদান রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই এমআরটির এসব প্রকল্প নিয়ে বিকল্প চিন্তা করছে সরকার।

আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘একটা প্রকল্পের অনেক কম্পোনেন্ট থাকে, যার ব্যয়ও কমানো যায়। যেমন রেলের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্টেশনে রেস্টহাউজের তেমন একটা প্রয়োজন নেই, তবু সেখানে রেস্টহাউজ তৈরি করা হয়েছে।

এগুলোর ফিজিবিলিটি স্টাডি আবার খতিয়ে দেখা দরকার।’ তিনি আরও বলেন, সরকারের সিদ্ধান্তের আলোকে কোন প্রকল্প কী অবস্থায় আছে, এর অর্থনৈতিক আউটপুট কতটা হতে পারে, সেটি পুনরায় বিবেচনা করা হবে। এ ছাড়া যে প্রকল্পগুলো জনবান্ধব এবং ফলাফল তৎক্ষণাৎ পাওয়া যাবে, সেগুলোকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত মন্তব্য করে আইএমইডি সচিব বলেন, প্রথমত, জাতীয় মূল্যায়ন কমিটির মাধ্যমে একটি দৃশ্যমান আইন প্রণয়ন করা জরুরি। পরে ওই আইন অনুযায়ী দৃশ্যমান শাস্তির ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘রাজনৈতিক সরকারের আমলের মতো দেশে আর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্প থাকবে না। গত দেড় দশকে নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। বড় বড় প্রকল্প কেন এতবার সংশোধন করা হয়েছে? নকশা কেন সংশোধন করতে হয়েছে? বারবার সংশোধন ও ব্যয় বাড়াতে হয়েছে। কাদের স্বার্থে এগুলো করা হয়েছে? অদক্ষতা বা কিছুটা হলেও ঠিকাদারদের যোগসাজশে এসব করা হয়েছে। ভবিষ্যতে যাতে এ রকম ভুল আমরা না করি, সে জন্য চেষ্টা থাকবে। এর জন্য একটি প্রতিবেদন তৈরি করা দরকার। সরকারের অনেক জায়গায় বড় বড় দুর্নীতি আছে। এটা আমরা সবাই জানি। সেগুলো অনেক কম খরচে হতে পারত। কিন্তু উপযুক্ত মূল্যায়ন ও উপযুক্ত বাস্তবায়নের অভাবে খরচ বেড়ে গেছে। দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর প্রতি ইউনিট রাস্তা বা সড়ক বা বিভিন্ন অবকাঠামোয় যে ব্যয় হয়েছে, তা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আমরা সেগুলো দেখছি। তবে সময় লাগবে।’

সোয়া ২ লাখ কোটি টাকার ৭ প্রকল্পের ব্যয় যাচাই হবে: বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশকিছু বড় প্রকল্প নেওয়া হয়, যেগুলো মেগা প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকায় মেট্রোরেল চালু, পদ্মা সেতু, চার লেন সড়ক এসব মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু বেশ কিছু প্রকল্প রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল বলে আলোচনা আছে। আবার বেশি অর্থ ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। নতুন সরকার এখন এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা খুঁজছে। প্রাথমিকভাবে আইএমইডি কাজ শুরু করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আগের সরকারের নেওয়া প্রকল্পগুলো অবশ্যই পর্যালোচনা করা উচিত। পদ্মা সেতু প্রকল্প শেষ হলো, কিন্তু খরচের তুলনায় অর্থনীতিতে কতটা মূল্য সংযোজন করতে পারছে? পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত জাহাজ চলাচল মসৃণ করতে প্রতি বছর প্রায় ৫ কোটি ডলার (৬০০ কোটি টাকা) লাগবে।

শোনা যাচ্ছে, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পুরোনো আমলের চুল্লির কারণে ইউরেনিয়াম বেশি লাগবে। চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়েছে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি ট্রেন চলে। এসব প্রকল্পে বিপুল অর্থ খরচ হয়ে গেছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!