ঢাকা শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর, ২০২৪
সিন্ডিকেটে ১২ বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা লুট

মাফিয়া রাঙ্গা লাপাত্তা

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২৪, ১২:৩৯ এএম

মাফিয়া রাঙ্গা লাপাত্তা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

গত ১৫ বছরে দেশের পরিবহন খাত থেকে চাঁদাবাজির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব এবং পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গার বিরুদ্ধে। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে তিনি লাপাত্তা হয়ে গেছেন। ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞের ততোধিক মামলায় আসামি হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। গ্রেপ্তার এড়াতে দেশের ভেতরে বারবার স্থান পরিবর্তন করছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, দেশের পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি চক্রের একজন ছিলেন তিনি। গত দেড় দশক ধরে চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠনিক রূপ দেয় রাঙ্গার পরিবহন সিন্ডিকেট। ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ১২ হাজার কোটি টাকা লুট করেছে মসিউর রহমান রাঙ্গা, শাজাহান খান ও এনায়েত উল্যাহ সিন্ডিকেট। চাঁদাবাজির টাকায় দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে। দেড় দশক ধরে দেশের সড়ক পরিবহন খাতে দাপিয়ে বেড়ানো রাঙ্গার সাম্রাজ্য এখন আর নেই। পট পরিবর্তনের পর গ্রেপ্তার এড়াতে চলে গেছেন আত্মগোপনে, অপেক্ষায় রয়েছেন পরিস্থিতি প্রতিকূল হওয়ার। বিগত দিনে যে কয়েকজন মিলে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি ও লুটপাট করেছেন, রাঙ্গা ছিলেন তাদের একজন।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতিতে টানা ১৫ বছরের বেশি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত সাবেক মহাসচিব, সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ ও রংপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা। রাজনীতির মাঠে নানা কারণে আলোচিত ও সমালোচিত এই নেতা এখন গা ঢাকা দিয়ে আছেন। গত দেড় দশকে পরিবহনে নিয়ন্ত্রণহীন চাঁদাবাজি আর অপকর্ম করে বাড়ি-গাড়িসহ দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। স্বৈরাচার এরশাদ পতনের আন্দোলনে নিহত শহিদ নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর’ বলে আলোচিত হন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছিলেন। সংসদে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বন্দনায় মেতে থাকতেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন জাতীয় পার্টির একসময়ে দ্বিতীয় শীর্ষ এই নেতা। রাতের ভোটে বা বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজিতে দেশের আইনকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করেছেন।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ দিন পার হলেও পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলার চেষ্টায় আওয়ামী লীগের দোসররা। স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিবহন সেক্টর মসিউর রহমান রাঙ্গা, শাজাহান খান, এনায়েত উল্যাহ ও ওসমান আলীর আধিপত্য চলত। এখন তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক হত্যা মামলা। শাজাহান খান ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে রয়েছেন জেলখানায়। খন্দকার এনায়েত উল্যাহ রয়েছেন বিদেশে এবং ওসমান আলীসহ পরিবহন খাতের অনেক নেতা রয়েছেন দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে। এরই মধ্যে পরিবহন খাতকে চাঁদামুক্ত ও সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় বিআরটিএ ও সরকারের কতিপয় সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। কিন্তু কতিপয় গণপরিবহনের মালিক নামধারী কিছু ব্যক্তি নতুন কৌশলে পরিবহন খাতকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা।

মূলত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার আমলে পরিবহন খাতের পঞ্চপাণ্ডব নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাদের একজন ছিলেন মসিউর রহমান রাঙ্গা। রুট নির্ধারণ, ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানিরও অন্যতম কারণ ছিল পরিবহন মালিকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতা পরিবহন মালিকদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে জিম্মি ছিল গণপরিবহনব্যবস্থা। তাদের পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় থাকা পরিবহনগুলোর কারণে রাজধানীর পরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরেনি, মানা হতো না সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়মনীতি। এই খাতে গত দেড় দশকে ক্রমবর্ধমান নৈরাজ্যের নেপথ্যে ছিল রাঙ্গা, শাজাহান খান ও এনায়েতউল্যাহ সিন্ডিকেটের রাজনৈতিক অশুভ প্রভাব। পরিবহনে চাঁদাবাজি করে এসব প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করতেন। তাদের কাছে যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। রাঙ্গা সিন্ডিকেটের নেতাদের মালিকানাধীন বাস কোম্পানিগুলোই রাজধানীতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। জেলা-উপজেলার সড়ক পরিবহনেও রাঙ্গা সিন্ডিকেটের দাপট ছিল। আর এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক ফেডারেশনের কয়েকজন নেতা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু হলেও মশিউর রহমান রাঙ্গারা রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রকেরা খোলস পাল্টে এখনো চলছে পরিবহনে চাঁদাবাজি।

মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির রংপুরের নেতা প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা সঞ্চিতা পরিবহনের মালিক। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির (মালিকদের সংগঠন) সভাপতিও তিনি। পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। সরকারের বাসভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ছিল এই সিন্ডিকেটের।

সরকারনির্ধারিত ভাড়া না মানলেও পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত না সরকার। তাদের কথাই ছিল সড়কে আইন। গত সরকার সড়ক আইন প্রণয়ন করলেও সিন্ডিকেটের চাপে আইনের ধারা শিথিল করে। সিন্ডিকেটের ইশারাতেই কথায় কথায় যান চলাচল বন্ধ রেখে মানুষের ভোগান্তিকে জিম্মি করে দাবি আদায় করতেন পরিবহন কর্মীরা। হাসিনা সরকারের দেড় দশকের শাসনামলের মধ্যে ১৪ বছরে শুধু সড়ক ও মহাসড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজে ২৯ হাজার কোটি থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে বলে ধারণা পেয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে পরিবহন সেক্টরে ১২ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজির নামে লুট করেছে মসিউর রহমান রাঙ্গা, শাজাহান খান ও এনায়েতউল্যাহর লোকজন। চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠনিক রূপ দেওয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরদ্ধে।

রংপুর-১ (গঙ্গাচড়া-সিটি করপোরেশনের আংশিক) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও জাতীয় সংসদের সাবেক বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা ২০২৩ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, নগদ অর্থের পরিমাণ গত পাঁচ বছরে বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ। একই সঙ্গে তার জমিসহ স্থাবর সম্পত্তিও বেড়েছে। পাঁচ বছর আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো অর্থ জমা না থাকলেও এবার ১ কোটি ৬৯ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯৩ টাকা দেখিয়েছেন সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী ও তিনবারের সংসদ সদস্য রাঙ্গা।

মসিউর রহমান রাঙ্গার হলফনামায় দেওয়া তথ্যে জানা গেছে, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাংক ঋণ দেখানো হয়েছিল ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৫ টাকা। কৃষি খাত থেকে আয় হয়েছিল বছরে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৮ টাকা। এ ছাড়া বাড়িভাড়া পেতেন ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৮৭ টাকা। ব্যবসা বাবদ তার আয় ছিল ৪৪ লাখ ৬৯ হাজার ৩৫ টাকা। চাকরি খাতে আয় দেখানো হয়েছিল ২১ লাখ ৪১ হাজার ৫৮০ টাকা। অন্যান্য খাতে আয় ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। রাঙ্গার স্থাবর সম্পদ, কৃষিজমি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক দালান এবং ফিলিং স্টেশন রয়েছে। পেশায় পরিবহন মালিক ও সাধারণ ব্যবসায়ী বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এর আগে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, তার নগদ অর্থ ছিল ২৭ লাখ ৮ হাজার ৫৪৬ টাকা। পাঁচ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ২৪ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ টাকায়। পাঁচ বছর আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ছিল ৮৯ লাখ ৫৬ হাজার ৯৩৪ টাকা। এবার দেখানো হয়েছে ২ কোটি ১ লাখ ৪ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে বেড়েছে জমিসহ স্থাবর সম্পত্তিও। ২০১৮ সালের হলফনামায় জমির পরিমাণ ১২ একর ৩৩ শতক দেখানো হয়েছিল। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ একর ৫৪ শতকে। পাঁচ বছর আগে কৃষি, অকৃষি জমি, আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন, বাগান ও খামারের মূল্য ও আয় ছিল ৩ কোটি ৬৪ লাখ ২০ হাজার টাকা। এবার দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৬ টাকা। ২০১৮ সালে তার ব্যাংক ঋণ দেখানো হয় ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৫ টাকা। এবারের হলফনামায় ব্যাংক ঋণ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৭ টাকা। আয়ের উৎস হিসেবে দেখিয়েছেন কৃষি খাত, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা, চাকরিসহ শেয়ার ও সঞ্চয়পত্র।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মসিউর রহমান রাঙ্গার মোবাইল নম্বরে বারবার কল দেওয়া হলেও প্রথমে রিসিভ করেননি। একপর্যায়ে একজন নারী কল ধরে নিজেকে রাঙ্গার মেয়ে দাবি করেন। তিনি বলেন, তার বাবা বাসায় নেই। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কী বিষয়ে ফোন করেছি জানতে চান। অভিযোগের বিষয়ে জানার পর বলেন, এ বিষয়ে তো আমি বলতে পারব না। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ দিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি।

শহিদ নূর হোসেনকে ‘ইয়াবাখোর’ বলেছিলেন: রাঙ্গা ২০১৯ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নিহত নূর হোসেনকে নেশাগ্রস্ত, ইয়াবা ও ফেন্সিডিলসেবী অভিহিত করে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়েন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর বুকে ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে রাস্তায় নেমেছিলেন নূর হোসেন। মিছিলটি ঢাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ এলাকায় পৌঁছালে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে তাকে জাতীয় পার্টির সব ধরনের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

সংসদে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বন্দনায় রাঙ্গা: ২০২৩ সালের ৮ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে সংসদে আনা সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে মো. মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেছিলেন, একটি আঁতেল শ্রেণি ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর যত উন্নয়ন মেনে নিতে পারছে না। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশেষ পরিচিত লাভ করেছে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ আজ সত্যিকারের ক্ষুধা, মন্দা, দরিদ্রতাহীন বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। দেশের উন্নয়নে একটি আঁতেল শ্রেণি ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর যত উন্নয়ন মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা দেশকে নিয়ে সব সময় চক্রান্তের জাল বুনছে। তাদের এই চক্রান্তের জাল কোনো দিনই সফল হবে না।

আরবি/জেডআর

Link copied!