ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪

বুলবুলের হাতে জাদুর কাঠি

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: অক্টোবর ২২, ২০২৪, ০১:৩০ এএম

বুলবুলের হাতে জাদুর কাঠি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মো. জাহাঙ্গীর আলম। ডাক নাম বুলবুল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় রংপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুলবুল একই আসনের স্থায়ী বাসিন্দা ও বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা হওয়ায় বিশেষ যোগ্যতায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসেন। শেখ হাসিনার নজরে আসার পরই দ্রুত বনে যান প্রবল ক্ষমতার উৎসমুখে।

২০১৬ সালে বুলবুল সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (পিএস-১) হিসেবে নিয়োগ পান। তারপরই আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরিবার নিয়ে থাকতেন গণভবনে। গণভবন থেকে পাওয়া প্রবল ক্ষমতার সেই জাদুর কাঠি তিনি এখন অন্তর্বর্তী সরকারেও নাড়ছেন।

১৬ বছর ধরে হাসিনা সরকারের নান্দনিক সৌন্দর্য বিলি করে এখন তিনি ড. ইউনূস সরকারের স্বপ্নের কারিগর। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঘুরে এখন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য তিনি।

ক্ষমতার উৎসমুখে থেকে টাকা, ডলার ও পাউন্ড কামিয়েছেন দুই হাতে, যার অতি সামান্য বিনিয়োগ করেন দেশে। মোট তিনটি ভবন ও একটি ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন তিনি। তবে কানাডার মন্ট্রিয়লে রয়েছে পাঁচটি বাড়ি। কানাডা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এহিয়া আহমদের মাধ্যমে এসব করেন তিনি। রয়েছে কানাডার ১০ বছরের মাল্টিপল ভিসা।

ছোট ছেলে সিয়াম এখন কানাডায় লেখাপড়া করছেন। সরকারের প্রভাবশালী আমলা হয়েও বুলবুলের গৃহিণী স্ত্রী মোমেনা শিমুর সম্পদ বেশি। ক্ষমতার অপব্যবহারেও ছিলেন শীর্ষে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনের নেপথ্যে ছিলেন প্রবল দাপুটে বুলবুল।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। গণভবনে হামলার পর বিকেলে হঠাৎ তার সরকারি বাসভবনে লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। বাসার পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে মৃত্যুর কাছ থেকে বাঁচে তার পরিবার।

তবে জনশ্রুতি রয়েছে, অনেক মালামালের সঙ্গে তার বাসা থেকে লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এরপর দ্রুত নিজেকে সামলে বদলে ফেলেন। এখন বৈষম্য দূরীকরণে পরিকল্পনা কমিশনে বসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন কারিগর। ‘কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লীপ্রতিষ্ঠান’ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এখন মো. জাহাঙ্গীর আলম।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে রংপুর সফর: বৈষম্যবিরোধী বা কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহীদ হন।

পুলিশের গুলিতে ‘প্রসারিত বুকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন’ করেন আবু সাঈদ। দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে জুলাইয়ের শেষে আন্দোলন দমাতে বিমানযোগে রংপুরে যান বুলবুল। সাবেক স্পিকার ও রংপুর-৬ আসনের সংসদ সদস্য ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সফরসঙ্গী হয়ে বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করেন তিনি।
রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার উজিরপুরে তার গ্রামের বাড়ি। 

উপজেলা সদরের পশ্চিমে বাবুনপুর গ্রামে নিহত আবু সাঈদেরও বাড়ি। সফরসঙ্গী হিসেবে নিজের গ্রামের বাড়িতে গেলেও সে সময় পাশের গ্রামে প্রতিবেশী আবু সাঈদের সমাধিস্থলে যাননি তিনি।

সংসারধর্ম: মো. জাহাঙ্গীর আলম ও মোমেনা শিমু দম্পতি তিন সন্তানের বাবা-মা। বড় ছেলে শামীম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত। আরেক ছেলে সিয়াম বিনিয়োগ ভিসায় দুই বছর আগে কানাডায় লেখাপাড়ার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। সেখানেই এখন আয়ের বেশির ভাগ অর্থ ঢালেন তিনি। ছোট মেয়ে ঢাকার মোহম্মদপুরের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

শ্বশুর ঢাকায় কাস্টমসে কর্মরত ছিলেন, সম্প্রতি তিনি মারা যান। তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সারিয়াকান্দি। স্ত্রী দুজন হলেও প্রথম স্ত্রীর ঘরে দুই কন্যা এবং এক পুত্রসন্তান রয়েছে। শ্বশুরে প্রথম স্ত্রীর দ্বিতীয় মেয়ে মোমেনা শিমুকে বিয়ে করে সংসারধর্ম পালন করছেন বুলবুল। স্ত্রীর বড় বোন বর্তমানে নিউইয়র্কে বাস করেন। শেখ হাসিনার এপিএস থাকাকালে দুহাতে কামানো অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন স্ত্রীর বড় বোনের কাছে। তবে এ বিষয়ে স্ত্রীর বড়বোনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

শিক্ষাজীবন, রাজনীতি ও কর্মজীবন: রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামে তার বাড়ি। কৃষক বাবার পরিবারে তিন ভাই ও এক বোন তারা। শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনে করতেন ছাত্র ইউনিয়ন। 

চাকরিজীবনের শুরুতে হয়ে যান আওয়ামী লীগপন্থি সেরা নেতা। সেই সুবাদে ঢাকার অফিসার্স ক্লাবের শীর্ষ নেতা হয়ে ওঠেন। ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে ২০১৬-১৭ কার্যনির্বাহী কমিটির নির্বাহী সদস্য, ২০১৮-১৯ কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর টানা দুই মেয়াদে ২০২০-২১ এবং ২০২২-২৩ কার্যনির্বাহী কমিটির কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে সবশেষ ২০২৪-২৫ কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনে (ব্যালট নং-২) হেরে যান তিনি।

ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সুবিধাভোগী: ২০০৯ সালে রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে শ্বশুরবাড়ি (ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি) এলাকায় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন শেখ হাসিনা। সরকার গঠনের পরে একই উপজেলায় বাড়ি হওয়ায় নৌকায় উঠে পড়েন বুলবুল। আঠার মতো লেগে থাকায় ২০১৬ সালে নিয়োগ পান সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ হিসেবে। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ মন্ত্রণালয় ঘুরে সমাজকল্যাণ সচিব ছিলেন। সবশেষ (সরকার পতনের আগে) স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ছিলেন মো. জাহাঙ্গীর আলম।  
তৃতীয় মেয়াদে ২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার কথিত মেয়ে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সাবেক এই স্পিকারের নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরির মূলে ছিলেন তিনি এবং তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন, যারা আড়ালে থেকে অপরাধ ও অপকর্মের শীর্ষে ছিলেন।

সুবিধাভোগী হলেও ড. ওয়াজেদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছিল তার বৈরী আচরণ। শেখ হাসিনা ও শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে থাকায় এলাকায় নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্পদ অর্জন: আয়ের অতি সামান্য ঢাকায় বিনিয়োগ করেন তিনি। রংপুরের মুলাটোলে চারতলা ভবন, ঢাকার উত্তরায় ১৪ নম্বর সেক্টরে ৫ কাঠার প্লটে ছয়তলা ভবন, শেওড়াপাড়ায় ছয়তলা একটি ভবন এবং মোহাম্মদপুরে রেসিডেনশিয়াল স্কুলের পেছনে ২ হাজার ৫০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে সামান্য কৃষিজমি।

বিশেষ একটি সূত্র জানিয়েছে, এসব সম্পদের মালিক স্ত্রী মোমেনা শিমু। বাবা তাকে দান করেছেন। একমাত্র ভাইও পেয়েছেন ঢাকার মনিপুরে একটি জমি। তবে স্ত্রীর অন্য মায়ের সন্তানেরা নিঃস্ব হওয়ায় উঠেছে প্রশ্ন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এপিএস থাকার সময় ঠিকাদারের কাছ থেকে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন। নিউইয়র্কে স্ত্রীর বড় বোনের কাছে রয়েছে সেই সম্পদ। কানাডায় মন্ট্রিয়লে গড়েছেন পাঁচটি বাড়ি। সেখানে বিনিয়োগের মাধ্যমে পড়ালেখার সুযোগ পেয়েছেন ছোট ছেলে সিয়াম। কানাডা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এহিয়া আহমদের মাধ্যমে তিনি এসব সম্পদ গড়েন। রয়েছে কানাডার ১০ বছরের মাল্টিপল ভিসা।

আওয়ামী সরকারের পতনের সময় ঢাকায় ছিলেন সিয়াম। সম্প্রতি কানাডায় ফিরে কানাডা আওয়ামী লীগের শীর্ষ এক নেতার বাসায় ওঠেন। বাংলাদেশ থেকে পলাতক অনেক নেতা এখন সেখানেই আশ্রয় নিয়েছেন বলে বিশেষ সূত্র জানিয়েছে। তবে নিউইয়র্ক ও কানাডায় গড়া সম্পদের পরিমাণ অনুসন্ধান করে দেখার সুযোগ হয়নি রূপালী বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের।

চাকরিজীবন ও গুরুত্বপূর্ণ পদ: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পরই কপাল খোলে তার। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব (পিএস-১) হিসেবে থাকতেন গণভবনে। সেখান থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং সেখান থেকে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব।

২০২৩ সালের ৫ অক্টোবর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ সচিব হন। সেখান থেকেই সরকারের আরও গুরুত্বপূর্ণ খাত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব হন বুলবুল। তার জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুগ্ধ হয়ে পরে পরিকল্পনা কমিশনে বসায়। সেখানে বসে শেখ হাসিনার ক্ষমতার জাদুর কাঠি এখন অন্তর্বর্তী সরকারে নাড়ছেন বুলবুল।

অভিযুক্ত মো. জাহাঙ্গীর আলম বুলবুলের বক্তব্য: ‘শুধু কানাডা কেন, পৃথিবীর কোথাও আমার কোনো সম্পদ নেই। কানাডার মন্ট্রিয়লে পাঁচটি বাড়ি আছে এই গুজব অনেক আগের। আওয়ামী লীগের যে এয়াহিয়ার কথা বলা হচ্ছে, সিলেটে তার সম্পদ দখল করা হয়েছে। সম্পদ উদ্ধারে আমি তাকে সহযোগিতার চেষ্টা করেছিলাম। কানাডার ১০ বছরের মাল্টিপল ভিসা আমার নেই। তবে গ্রামের বাড়িতে কিছু কৃষিজমি আছে।’

‘আপনি আমার অফিসে আসুন আমার পাসপোর্ট দেখে যান। কানাডার মাল্টিপল ভিসা আছে কি না, দেখেন। যা শুনেছেন, সব গুজব। একটি পক্ষ বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে আমার সম্মানহানির চেষ্টা করছে। তবে রংপুর ও ঢাকায় কিছু সম্পদ আছে। এগুলো আমার স্ত্রী পৈতৃক সূত্রে পেয়েছেন। ঢাকায় আমার ফ্ল্যাটও নেই।’

‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে আমি জড়িত ছিলাম না। সাবেক স্পিকারের সঙ্গে জুলাইয়ে রংপুর সফরও করিনি। কারণ সাবেক স্পিকারের সঙ্গে আমার দা-কুড়ালের সম্পর্ক ছিল। তিনি মনে করতেন, তার রাজনীতিতে আমি ভাগ বসাব। আমি চাকরি করি, রাজনীতি নয়। এটা তাকে অনেকবার বুঝিয়েছি।’
‘চাকরিজীবনে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে কখনো আমি আপস করিনি। দেশের বাইরে কোথাও আমার কোনো সম্পদ আছে দেখাতে পারলে সব শাস্তি মেনে নেব।’

আরবি/জেডআর

Link copied!