ঢাকা বুধবার, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫

বড় ঘাটতির পথে প্রধান খাদ্য চাল

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৮, ২০২৫, ০১:০৯ এএম

বড় ঘাটতির পথে প্রধান খাদ্য চাল

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আমনের ভরা মৌসুমে বেড়েছে চালের দাম। মোটা এবং চিকন সর ধরনের চালে দাম বেড়েছে। ঢাকার সব বাজার এবং দেশে জেলা শহরগুলোতেও স্থানবিশেষে কেজিতে দাম বেড়েছে ৩-৭ টাকা। ৫০ কেজি চালের বস্তার দাম ৩ হাজার থেকে বেড়ে ঢাকার কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটে সর্বোচ্চ ৩৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বস্তায় বেড়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা। যার প্রভাব পড়ছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, মোটা চালের দাম বেড়েছে মূলত সর্বশেষ এক সপ্তাহে কেজিতে তিন থেকে চার টাকা। দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলেন, বাজারে চাহিদা এবং সরবরাহ ঠিক থাকলেও মোকামে ধানের দাম বেশি। ফলে উৎপাদিত চাল বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

আরও কারণ হিসেবে বলছেন, কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে ধান কিনছেন মৌসুমি ব্যবসায়ী ও করপোরেট কোম্পানির প্রতিনিধিরা। স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ ১৩৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে আমন ধান। বেশি দাম পাওয়ায় খুশি কৃষক। যার কারণে চাল উৎপাদনকারী মিলার এবং সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে ধান নেই বললেই চলে। তারা ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন।

অন্যদিকে, কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, দেশের মোট ধান উৎপাদন পরিসংখ্যানে ব্যাপক ফারাক রয়েছে, যা সরকারকে নিশ্চিত করা দরকার। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বর্ষাকালে এখন বর্ষা নেই। অনাবৃষ্টিতে জমিতে সেচ দিতে চাইলেও পারছে না কৃষক।

কারণ, বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও বাধ্যতামূলকভাবে পল্লী বিদ্যুৎকে ২০ শতাংশ ভর্তুকি বাদে ৯১২ টাকা দিতে হচ্ছে কৃষককে। প্রকৃত কৃষক পল্লী বিদ্যুতের অহেতুক হয়রানি ও অতিরিক্ত বিল থেকে বাঁচতে আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। বেশির ভাগ সেচ পাম্প বন্ধ। ফলে উৎপাদন কমায় কৃষি খাতে গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ প্রভাব পড়েছে জিডিপিতে। এদিকে কৃষককে সেচ পাম্পের অনুমোদন দিলেও দেখভাল করছে না বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (সেচ) বিভাগ।

অনুমোদনের পর ‘ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেই’ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

কৃষিবিজ্ঞানী এবং ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভরা মৌসুমে সারা দেশে চালের দাম বেড়েছে। এটি বিশেষ সংকেত; যা দীর্ঘমেয়াদি আশঙ্কার সৃষ্টি করবে এবং যার প্রভাব অনেক খাতে ছড়িয়ে যাবে। বিশেষত, করপোরেট গ্রুপের ব্যবসায়ীরা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে যাচ্ছেন। উৎপাদন বৃদ্ধিতে দৃষ্টি এবং সামাল দিতে আমদানি সরবরাহ ঠিক রাখার কথা বলছেন তারা।

যদিও অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যাশা করেছিল, আমন ধান এলে চালের দাম কমবে। তবে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, সম্প্রতি ভারতের চাল দেশে আসায় দামে স্থিতি রয়েছে। আমদানি বন্ধ হলেই অনেক গুণে দাম বেড়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা করেছেন।

চলতি বছর রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাটে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ১৩৫০ টাকায়। হাটে আসা কৃষক আনিছার রহমান বলেন, ‘স্বাধীনতার পর ধানের সর্বোচ্চ দাম পেয়েছি। আমি খুব খুশি। আমন ধান কেটেই ১৩০০ টাকায় বিক্রি করেছি। বাইরের লোক ধান কিনছে।’

পীরগঞ্জ উপজেলার ব্যবসায়ী লালমিয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাটেই এক মণ ধানের দাম ১৩৫০ টাকা। চাল হয় ২৮ কেজি। কিনেই প্রতি কেজি চালের দাম পড়ে ৪৮ টাকার বেশি। তার সঙ্গে অন্য খরচ যোগ করে টিকে থাকা অসম্ভব।’

‘পুরাতন চাল নেই, এখন নতুন চাল আসছে’ বলেন ঢাকার কারওয়ান বাজারের চাটখিল এজেন্সির মালিক বেলাল হোসেন। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ভারতের চাল আসায় তবুও দাম কম। দেশের সব স্থানে দাম বেশি। আমরা কম দামে কিনে সামান্য লাভে বিক্রি করতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘ভরা মৌসুমে এখন ২৫ কেজি চালের বস্তা সর্বোচ্চ ৩৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বস্তায় বেড়েছে ৩৫০-৪০০ টাকা।’ 

রাজশাহী জেলার চালকলগুলোতে বেশি উৎপাদিত হয় কাটারি, জিরাশাইল, নাজিরশাইল ও মিনিকেট চাল। মিলারের উৎপাদিত মোটা ও চিকন চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ থেকে ১০ টাকা। এক সপ্তাহে প্রতি বস্তায় দাম বেড়েছে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। তবে দাম বৃদ্ধির পেছনে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের দুষছেন মিলাররা। 

রাজশাহীর সাহেববাজারের চাল ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মানভেদে ৫০ কেজি চালের প্রতি বস্তায় এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। কারণ আমরা পাইকারি দরে কিনে সামান্য লাভ করে বিক্রি করে দিই।’ 

নগরের সাগরপাড়া এলাকার অমিত স্টোরের স্বত্বাধিকারী অমিত সরকার বলেন, ‘আড়ত থেকে চাল কিনতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে আমাদের। গত এক সপ্তাহের মধ্যে দাম বেড়ে গেছে। প্রতি বস্তায় ৪০০-৫০০ টাকা বাড়তি গুনতে হয়। আবার বাড়তি দামে বিক্রি করা হলে গ্রাহকরা অসন্তুষ্ট হচ্ছেন।’

রাজশাহী চালকল মালিক সমিতির সভাপতি রফিকুল ইসলামও ধানের দামকে দায়ী করছেন। তিনি বলেন, ‘চালের দাম বাড়লেই আমাদের দোষ হয়। কিন্তু এখন ধানের দাম বাড়তি থাকায় চাল করতে বেশি খরচ পড়ছে। এ কারণে মিল থেকে দাম বাড়ানো হয়েছে।

চাল উৎপাদনে শীর্ষে থাকা দিনাজপুরের বিরলের রূপালী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানেও ধানের দাম বেশি। যার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।’ 

‘ধান ও চালের দাম অনেক বেড়েছে’ বলেন চালকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এইচ আর খান পাঠান। তিনি বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারি গুদামে চাল সরবরাহের গতি হয়তো কিছুটা ধীর। তবে বেশির ভাগ চালকল মালিক সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে চাল সরবরাহ করবেন।’

বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বারি) সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিজ্ঞানী ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, ‘দেশের মোট ধান উৎপাদনের পরিসংখ্যানে ফারাক রয়েছে। এটি আগে সরকারকে নিশ্চিত করা দরকার। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এখন বর্ষাকালে আর বর্ষা হয় না। বর্ষায় অনাবৃষ্টি হচ্ছে। ধানের জমিতে সেচ দিতে চাইলেও পারছেন না কৃষক।’

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গ্রামের বেশির ভাগ কৃষকের সেচ পাম্প এখন বন্ধ থাকে। পল্লী বিদ্যুতের হয়রানি ও অতিরিক্তি বিল থেকে বাঁচতে আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন তারা। বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও প্রতি মাসে বাধ্যতামূলকভাবে পল্লী বিদ্যুৎকে দেওয়া ২০ শতাংশ ভর্তুকি বাদে (গভীর নলকূপ) ৯১২ টাকা দিতে হচ্ছে কৃষককে।’

সরকারের প্রতি সুপারিশ হিসেবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, ‘উৎপাদন বাড়াতে সারা বছর সেচ দরকার। তাই কৃষি খাতে সরকারকে ছাড় দিতে হবে। জলবায়ু পবির্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তাহলে কৃষক সারা বছর উৎপাদনে থাকবে। এতে করে কৃষি অর্থনীতির আওতা বাড়বে এবং মূল্যস্ফীতি কমবে’ বলেন এই কৃষিবিজ্ঞানী।

আরবি/জেডআর

Link copied!