মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ভূইয়া মানিকগঞ্জ জেলা গণপূর্ত বিভাগের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত। তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী হলেও সিন্ডিকেট গড়ে তুলে ঠিকাদারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, ঘুষ, দুর্নীতি ও প্রকল্প থেকে কমিশন বাণিজ্য করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জমা পড়লেও মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। সরকার পরিবর্তন হয়েছে, তবু আতিকের ক্ষমতার দাপট কমেনি। ভোল পালটে ঠিকাদার ও অফিসের ঊর্ধ্বতন থেকে শুরু করে কর্মচারীদের পর্যন্ত তটস্থ রেখেছেন। মাত্র দুই দশকে এক কর্মচারীর আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ায় তার সহকর্মীরাও বিস্মিত।
আতিক অফিসের ডকুমেন্ট চুরি, টেন্ডারবাজি, জালিয়াতি, টেন্ডার ড্রপ করে তার পক্ষে থাকা সিন্ডিকেটের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়া, সাধারণ শাখা থেকে প্রাক্কলনের অফিস কপি লিক করে প্রাক্কলনের রেট ঠিকাদারদের জানিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এমনকি সরকারি জায়গা দখল করে নির্মাণ করেছেন দোকানও। ফলে গত ২০ বছরে তিনি কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, আতিকুর অফিস করেন শুধু ঘুষ ও দুর্নীতির সিন্ডিকেট রক্ষা করতে।
২০০৪ সালে মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগে যোগ দেওয়ার পর থেকে একই স্থানে কাজ করছেন আতিকুর রহমান। রাাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দিনের পর দিন তিনি হয়েছেন বেপরোয়া। তার দাপটে ঠিকাদারেরা অসহায়। কমিশন ছাড়া ঠিকাদারেরা মানিকগঞ্জ গণপূর্তে কোনো কাজ করতে পারেন না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ গণপূর্তের এই জেলা অফিসের প্রকৌশলী থেকে পিয়নও তার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত।
মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী অভিযোগ করেছেন, আতিকুর রহমানকে ম্যানেজ করা ছাড়া মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগে অফিস স্টাফ ও কর্মকর্তাদের বেতন বিল পর্যন্ত পাঠানো হয় না।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই আতিকুর রহমানের ভাগ্য খুলে যায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে তাদের ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দিত।
তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ, সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের আশীর্বাদপুষ্ট বিথী কনস্ট্রাকশনের মাধ্যমে তিনি মানিকগঞ্জে ঠিকাদারি কাজ পরিচালনা করেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে প্রতি টেন্ডার বাবদ তাকে অন্তত ৫ শতাংশ হারে টাকা দিতে হতো। এ নিয়ে স্থানীয় অনেক ঠিকাদারের সঙ্গে আতিকের একাধিকবার কথা-কাটাকাটি ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। আতিককে দিয়ে টেন্ডার না করালে সে ঠিকাদারদের লটারি থেকে বাদ দিয়ে তার পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেন।
আওয়ামী লীগের দেড় দশকের স্বৈরশাসনের আমলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দাপটের সঙ্গে দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। নানান অপকর্মের হোতা আতিকুর নিজ জেলা টাঙ্গাইল শহরে ১ হাজার ৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ক্রয়, টাঙ্গাইলে তার নিজের ও স্ত্রীর নামে ২৫ কাঠা জমি, বিভিন্ন ব্যাংকে তার এবং তার স্ত্রীর নামে কোটি টাকার এফডিআর, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের নামে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ রয়েছে কোটি টাকা। এ ছাড়া আতিকের স্ত্রীর কাছে শতাধিক ভরি স্বর্ণ রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, বর্তমানে মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বনাথ বণিকের অফিসের কম্পিউটারের আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন আতিকুর। এর মাধ্যমে অফিসে এবং ঠিকাদারদের ভয় দেখান, ‘নির্বাহী প্রকোশলীর সঙ্গে আমার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে।’ অভিযোগ আছে, মানিকগঞ্জ গর্ণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে আলাদা ফায়দা লোটেন আতিকুর। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বনাথ বণিক ও উপসহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় আতিকুরের এই সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠছে দিনে দিনে।
সম্প্রতি আতিকুরের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী ঠিকাদার মশিউর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক, আলাউদ্দিন ও মোস্তফা নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এর আগেও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ জমা দেওয়া হলেও ঊর্ধ্বতনরা ভয়ে ব্যবস্থা নেননি। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে রয়েছেন। আওয়ামী দোসররা পালিয়ে যাওয়ায় সাধারণ ঠিকাদারেরা আতিকুরের বিরুদ্ধে গত নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্তের আবেদন করেছেন। তবে সেই আবেদন বা তদন্ত কোন পর্যায়ে তা জানা যায়নি। এমনকি তদন্ত শুরু হবে কি না, তা-ও নিশ্চিত নন সাধারণ ঠিকাদারেরা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোহাম্মদ আতিকুর রহমান ভূইয়ার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে ফোন, মেসেজ এবং হোয়াটস অ্যাপেও ফোন ও মেসেজ দেওয়া হলে তিনি ফোন ধরেননি এবং মেসেজের উত্তর দেননি। আতিকুরের সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকা এবং অফিসের কম্পিউটারের আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে দেওয়ার বিষয়ে জানতে মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বনাথ বণিকের সঙ্গেও সব মাধ্যমেই যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি সাড়া দেননি।
মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাজু মল্লিক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আতিকুর রহমান সরাসরি নির্বাহী প্রকোশলী অফিসের অধীনে কাজ করেন। তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবেন নির্বাহী প্রকোশলীর অফিস। আমার সঙ্গে তার অফিশিয়াল কোনো সম্পর্ক নেই।
মানিকগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। আমাকে ফাঁসাতে আমার নাম নেওয়া হচ্ছে। একজন অফিস সহকারী দুর্নীতির মাধ্যমে কতই বা সম্পদ অর্জন করতে পারেন, সেই প্রশ্নও তোলেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :