কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ ধার করতে পারছে না। কারণ, তাদের হাতে কোনো সরকারি বিল বা বন্ড নেই। যেগুলো বন্ধক দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা নেবে। এ ছাড়া আর্থিক দুর্বলতা ও দুর্নামের কারণে অন্য কোনো ব্যাংক থেকেও তারা ধার পাচ্ছে না। এমনকি কলমানি মার্কেট থেকেও তাদের কোনো ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি ধার দিচ্ছে না। ফলে আর্থিক সংকটেরও সমাধান হচ্ছে না।
তারল্য সংকটে নতুন ঋণ বিতরণও বন্ধ। টানা লোকসান, মূলধন ঘাটতি ও উচ্চ খেলাপি ঋণে খাদের কিনারে থাকা ব্যাংকটি হচ্ছে ২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের ধ্বংসস্তূপ থেকে গড়ে ওঠা শরিয়াহভিত্তিক আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এদিকে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহর পুন:নিয়োগ আটকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিতে তার অনিয়মের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তদন্তের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ফলে এমডির পুন:নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সহসা কোনো সিদ্ধান্ত আসছে না। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে এমডির মেয়াদ শেষ হলে নিচের পদ থেকে কোনো যোগ্য কর্মকর্তাকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পর্ষদের চেয়ারম্যানকে। এ ক্ষেত্রে একই পদে সমমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা থাকলে যিনি জ্যেষ্ঠ তাকে ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের এমডি পদে মোহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহর নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর আগেই পর্ষদ থেকে তাকে একই পদে পুন:নিয়োগ দেওয়ার অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি পাঠানো হয়। এমডিও তার পুনঃনিয়োগ নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ চারদিকে দৌড়ঝাঁপ করতে থাকে। কিন্তু এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারে এমডি ব্যাংকটিতে গুরুতর কিছু অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তার পুনঃনিয়োগের প্রস্তাবটি আটকে দেয়। একই সঙ্গে এমডির অনিয়ম তদন্তের পদক্ষেপ নেয়। এদিকে এমডি পদে মোহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহর পুন:নিয়োগ অনুমোদনের অগ্রগতির বিষয়ে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে খোঁজখবর নিতে থাকে পর্ষদ। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয় ব্যাংকের পর্ষদের চেয়ারম্যানের কাছে। এতে বলা হয়, এমডির পুন:নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত এমডির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে বিধি অনুযায়ী এমডির নিচের পদের যেকোনো একজন যোগ্য কর্মকর্তাকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দিতে হবে। যদি ওই পদে একাধিক কর্মকর্তা থাকেন তবে যিনি জ্যেষ্ঠ তাকে ভারপ্রাপ্ত এমডি নিয়োগ করতে হবে। এ হিসেবে ব্যাংকের একজন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ভারপ্রাপ্ত এমডির পদ পাবেন।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, এ ক্ষেত্রেও নিজের লোকের কাছে দায়িত্ব দিতে এমডি তার পছন্দের লোককে ভারপ্রাপ্ত এমডি পদে বসানোর পাঁয়তারা করছেন। এ জন্য কৌশলে তৃতীয় পজিশনে আছেন এমন একজনকে প্রমোশন দিয়ে সামনে টেনে এনে ভারপ্রাপ্ত এমডির পদে বসানোর চেষ্টা করছেন। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে তাকে ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্ব দিতে উঠেপড়ে লেগেছেন। কিন্তু এমডির পছন্দের এই লোকের বিরুদ্ধেও অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তিনি এমডি মোহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহর নানা অনিয়মে সায় দিয়েছেন। একই সঙ্গে এর বিপরীতে নানা সুবিধাও নিয়েছেন। এ কারণে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে ভারপ্রাপ্ত এমডি পদে নিয়োগ না দেওয়ার দাবি করেছে। এসব বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
জানা গেছে, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের এমডি হিসাবে ২০১৪ সালে মোহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহ নিয়োগ পান। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে ব্যাংকটিতে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সন্ধান পায়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চিঠি দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। তারপরও তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি থামেনি। শুভ্র ট্রেডার্স নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৬ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় নানা অনিয়মের মাধ্যমে। ফলে পুরো ঋণটিই এখন খেলাপি হয়ে গেছে। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট ঋণের ৮৭ শতাংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে তারল্য সংকট। এ কারণে ব্যাংকটি চাহিদামতো গ্রাহকদের আমানতের অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও তারা বিশেষ ধার পাচ্ছে না। কারণ, তাদের হাতে কোনো সরকারি বিল বা বন্ড নেই। যেগুলো বন্ধক দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা নেবে। যে কারণে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কোনো ধার পাচ্ছে না। এ ছাড়া আর্থিক দুর্বলতা ও দুর্নামের কারণে অন্য কোনো ব্যাংক থেকেও তারা ধার পাচ্ছে না।
এমনকি কলমানি মার্কেট থেকেও তাদের কোনো ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কোম্পানি ধার দিচ্ছে না। ফলে আর্থিক সংকটেরও সমাধান হচ্ছে না। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হয়েছে, ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডারদের অর্থের জোগান দিয়ে তারল্য সংকটের সমাধান করতে। সেটিও সম্ভব হচ্ছে না, আইনগত জটিলতার কারণে।
জাল জালিয়াতির কারণে আর্থিক সংকটে জর্জরিত হলে ২০০৭ সালে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে একটি গ্রুপের বিরুদ্ধে ৭০০ কোটি টাকার জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। দুর্নীতির দায়ে ব্যাংকে থাকা ওই গ্রুপের সমুদয় শেয়ার বাজেয়াপ্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন নতুন শেয়ার সৃষ্টি করে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করে মালয়েশিয়ান কোম্পানি আইসিবি ইনকরপোরেট গ্রুপের কাছে। গ্রুপটি ব্যাংক পুনর্গঠন করার উদ্যোগ নিলে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করে ব্যাংকটিতে নতুন মূলধন জোগানের উদ্যোগ আটকে দেয়। ফলে গ্রুপটি এখন আর কোনো মূলধন জোগান দিতে পারেনি। ব্যাংকের আর্থিক সংকটও আর কাটেনি। বর্তমানে খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতিতে জর্জরিত এ ব্যাংক। খেলাপি ঋণ আদায় করা সম্ভব হয়নি বলে তারল্য সংকটও মেটেনি।
আপনার মতামত লিখুন :