মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে অপহরণের পর মুক্তিপণ চাওয়া হয় ১ কোটি টাকা। এই টাকা চেয়ে ফোন দেওয়া হয় তার স্ত্রী ও কন্যার মোবাইল ফোনে। রাত তখন ১টার কাছাকাছি। শুরু হয় দেনদরবার। এত টাকা তখন তাদের কাছে ছিল না। বারবার বিষয়টি নিয়ে অপহরণকারীদের সঙ্গে কথা হয়। শেষ পর্যন্ত অপহরণকারীরা ২৫ লাখ টাকা নগদ প্রদানের শর্তে তাকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়। গত বৃহস্পতিবার তখন রাত আড়াইটা।
এপার থেকে পরিবারের সদস্যরা বারবার অনুরোধ করেন, তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তারা টাকা নিয়ে আসছেন। কিন্তু ততক্ষণে তার ওপর হামলে পড়ে অপহরণকারীরা। তাকে কুপিয়ে মারাত্মকভাবে জখম করা হয়। রাত ৩টায় মিসবাহ সিরাজের কন্যা মুনতাহা আহমদ মিসবাহ প্রাইভেট কারে চড়ে ব্যাগভর্তি মুক্তিপণের টাকা নিয়ে রওনা হন। যেখানে অপহরণকারীরা মিসবাহ সিরাজকে রেখে যায়, তারই অদূরে সড়কমুখে অবস্থান করা আরেকটি গাড়িতে থাকা মাস্ক পরা অপহরণকারীদের কয়েকজনের হাতে তুলে দেন টাকা। টাকা বুঝে পেয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় তাকে।
আহত অবস্থায়ই মিসবাহ সিরাজকে পরিবারের সদস্যরা সিলেট নগরীর সাগরদীঘির পার এলাকা থেকে তাকে উদ্ধার করেন। তথ্য জানা গেছে কয়েকটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে। তবে তার পারিবার মুক্তিপণের টাকার কথা স্বীকার করলেও নির্দিষ্ট পরিমাণের বিষয়টি জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। সূত্র জানায়, উদ্ধারের পর তাকে রাতেই গুরুতর অবস্থায় সিলেটের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হয়েছে কয়েকটি অস্ত্রোপচারও। ততক্ষণে বিষয়টি কেউ জানতেন না। কিন্তু যখনই জানাজানি হয়, তাকে ওই হাসপাতাল থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। গতকাল শুক্রবার দিনেই তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঢাকার একটি অজ্ঞাত হাসপাতালে। বর্তমানে সেখানেই আত্মগোপনে থেকে তার চিকিৎসা চলছে।
অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। ছিলেন সিলেটের পাবলিক প্রসিকিউটর। সিলেট আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা। দলীয়প্রধানের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। এই পরিচয়ে তিনি নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সিলেট আওয়ামী লীগে। টাকা কামিয়েছেন দুই হাতে। তদবির কমিশন কোনো দিকেই তার জুড়ি ছিল না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সবাই যখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান, তিনি থেকে যান সিলেটেই। তবে ছিলেন আত্মগোপনে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে সিলেট মহানগরীর বিভিন্ন থানায় ৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত ১২টার দিকে নগরীর সুবিদবাজারের মিয়া ফাজিল চিশত এলাকায় একটি বাসার সামনে থেকে তাকে অপহরণ করা হয়। ভোর রাত সাড়ে ৩টার দিকে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় সাগরদিঘীর পাড় এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
একটি সূত্র মিসবাহ সিরাজকে অপহরণের সঙ্গে বিএনপির একটি গ্রুপ জড়িত থাকার দাবি করেছে। সূত্রমতে, সিলেট বিএনপিতে প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় এক নেতার নামে চলে এই গ্রুপ।
সূত্র জানায়, অপহরণ হওয়ার আগে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ সিএনজি অটোরিকশা করে মিয়া ফাজিল চিশত এলাকায় একটি বাসায় যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ওই এলাকার মাসালাবাজার সুপার শপের সামনে পৌঁছামাত্র কয়েকটি মোটরসাইকেলে আসা দুর্বৃত্তরা তার অটোরিকশার গতিরোধ করে। এ সময় অস্ত্রের মুখে তাকে অন্য একটি অটোরিকশায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। মিসবাহ সিরাজের স্বজনরা জানিয়েছেন, প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর সিলেটে দায়ের করা কয়েকটি মামলার আসামি হয়েছেন মিসবাহ সিরাজ। এ কারণে তিনি নগরীর মিয়া ফাজিল চিশত আবাসিক এলাকার নিজের বাসাতে না থেকে এলাকার অন্য একটি বাসায় থাকতেন। বিষয়টি একমাত্র পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কেউ জানতেন না। গতকাল দুপুরের পর তার আহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে।
স্বজনরা জানান, ভোর রাতে নগরীর সুবিদবাজারের পার্শ্ববর্তী সাগরদিঘীর পাড় এলাকা থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় দুর্বৃত্তদের চাহিদামতো টাকাও পরিশোধ করা হয়েছে।
তারা জানিয়েছেন, মিসবাহ সিরাজকে অপহরণের পর রাতেই তার ফোন থেকে স্ত্রী ও সন্তানকে মোবাইল ফোনে ফোন দেওয়া হয়। এরপর ওই দুর্বৃত্তদের তথ্যমতে, তাকে নগরীর সাগরদিঘীরপাড় এলাকা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সূত্র জানায়, সাগরদিঘীরপাড় রাস্তায় ছেড়ে যাওয়ার পর সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে রাগীব বাবেয়া হাসপাতালের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে নগরীর সোবহানীঘাটস্থ আল হারামাইন হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনরা। ভোররাত ৪টার দিকে তাকে ওই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় দেড় ঘণ্টার মতো তার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে তিন ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। গতকাল সকাল ১০টার দিকে তিনি ওই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান এবং এভারগ্রিনের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
আল হারামাইন হাসপাতালের পরিচালক ডা. চৌধুরী নাহিয়ান বলেন, ‘ভোররাত ৪টার দিকে মিসবাহ উদ্দিন সিরাজকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। এরপর তার পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়।
যদিও স্বজনেরা আমাদের জানিয়েছিলেন, তিনি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন।’ এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের বিরুদ্ধে ৭টি মামলা রয়েছে। দুর্বৃত্তরা তাকে অপহরণের পর মুক্তিপণ নিয়ে ছাড়ার বিষয়টি জানতে পেরেছি। ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত হয়েছেন। পুরো ঘটনাটি আমরা খতিয়ে দেখছি।
মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের মেয়ে মুনতাহা আহমদ মিসবাহ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, তার বাবার অবস্থা গুরুতর। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি মানুষ। কখনো কারো ক্ষতি করেননি। শুধু বলব, আমার বাবার অবস্থা গুরুতর।’ সবার কাছে তার বাবার সুস্থতার জন্য দোয়া চেয়েছেন।
আপনার মতামত লিখুন :