ঢাকা সোমবার, ১৩ জানুয়ারি, ২০২৫
ইইডির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ

কাজ শেষ না করে ১৬ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ঠিকাদাররা

সেলিম আহমেদ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২৫, ১২:৪৯ এএম

কাজ শেষ না করে ১৬ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ঠিকাদাররা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেট নগরীর ঐতিহ্যবাহী এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ স্কুল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ৬ তলা একটি ভবন নির্মাণের জন্য ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে কার্যাদেশ দেয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি)। চার কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে ভবনটি নিয়ম অনুযায়ী কার্যাদেশ দেওয়ার দেড় বছর পর কাজ শেষ হওয়ার কথা। অথচ কার্যাদেশ পাওয়ার চার বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইহসাক অ্যান্ড সন্স তুলে নিয়ে গেছে প্রায় ৩ কোটি টাকা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটিও। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, লাপাত্তা হওয়ার আগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি ১২ লাখ টাকা বেশি বিল নিয়ে গেছে।

রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের মতো সিলেটের গোপালগঞ্জের আতাহারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়েও ঘটেছে একই ঘটনা। নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বিদ্যালয়টির চারতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ৩০ শতাংশ কাজ বাকি। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসই-এই (জেভি) ইইডির সিলেট অফিসের শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে আঁতাত করে বরাদ্দের ৩ কোটি ২৭ লাখ টাকার মধ্যে ২ কোটি ২৩ লাখ টাকা তুলে নিয়ে গেছে। কাজ থেকে অন্তত ৫০ লাখ টাকা বেশি বিল তুলে নিয়ে গেছে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

এই দুই বিদ্যালয়ের মতো সিলেট জেলার অন্তত ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের কাজ শেষ না করেই গত ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ১৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদাররা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই তাদের অধিকাংশ লাপাত্তা। ফলে ভবনগুলোর বাকি কাজ শেষ হওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এ ছাড়াও বিগত ৫ বছরে সিলেটে যে নির্মাণকাজ হয়েছে তার অধিকাংশই নিম্নমানের বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি সম্প্রতি সিলেট জেলার নির্মাণাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে এসে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। 

ইইডি শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়,  সরকারি কাজে ঠিকাদারদের অগ্রিম বিল দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কাজের অগ্রগতি সরেজমিন পরিদর্শন করে বিল নিতে হয়। অর্থাৎ যতটুকু কাজ শেষ হয়েছে সেই পরিমাণ বিল পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু সিলেট জেলায় নির্মাণকাজের বিল দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিয়মকানুনই মানা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইইডির সিলেট অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, সিলেট জেলার কমপক্ষে ৮০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ কাজে ১৬ কোটি টাকার বেশি অগ্রিম বিল দেওয়া আছে। ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার যোগসাজশে এই টাকা উত্তোলন করে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে। কাজের থেকে বেশি টাকা তুলে নেওয়া এসব ঠিকাদারের বেশির ভাগই জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর পলাতক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিকভাবে বিগত পাঁচ বছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর কর্তৃক সিলেট জেলায় বাস্তবায়িত/বাস্তবায়নাধীন এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলো, পরিচালন বাজেটভুক্ত কর্মসূচি এবং মেরামত ও সংস্কার কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। দীর্ঘদিন আগে কার্যাদেশ প্রদান করা হলেও অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ এখনো শেষ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে ছাদ ঢালাই সম্পন্ন হলেও ফিনিশিং কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় ওই স্থাপনাগুলো ব্যবহার উপযোগী হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

চলমান প্রকল্পগুলোর অসম্পন্ন কাজ আগামী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে বলা হয়েছে। এই কমিটি আগামী তিন মাস পর কাজের অগ্রগতি সরেজমিনে পরিদর্শন করবে।

নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সিলেট জেলাধীন গোয়াইনঘাট উপজেলায় নির্মিত বীরমঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয়ের পুরো নির্মাণকাজের গুণগত মান ও ভবনের স্থায়িত্ব নিয়ে স্থানীয় জনগণ ও স্কুল কর্তৃপক্ষের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং সরেজমিনে পরিদর্শনে এ কমিটির কাছে বিদ্যালয়ের কলাম, বিম, ছাদ ও সিঁড়িতে ঢালাই কাজ মানসম্মতভাবে করা হয়নি মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। ওই ভবনের কলাম, বিম, ছাদ ঢালাইসহ কাজের গুণগতমান পরীক্ষাপূর্বক প্রতিবেদন প্রদানের জন্য একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ওই কমিটির প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর ভবনটির পরবর্তী নির্মাণ কার্যক্রমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে নির্মাণকাজ শুরুর আগে মাটি পরীক্ষা এবং ডিজাইন সম্পন্ন না করায় অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। তাই ভবিষ্যতে যেকোনো প্রকল্পের অধীন নির্মাণকাজের দরপত্র আহ্বানের আগে সয়েল টেস্ট এবং ডিজাইন সম্পন্ন করা প্রয়োজন।

সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকার দুটি বিদ্যালয়ের আইসিটি ল্যাব পরিদর্শনকালে কোনো ল্যাবেই কোনো শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত হতে দেখা যায়নি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে বিশেষ এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়েছে, সারা দেশে স্থাপিত আইসিটি ল্যাব এবং স্মার্ট পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের জন্য সরবরাহকৃত মাল্টিমিডিয়া সিস্টেমের কার্যকর ব্যবহারের নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের তদারকি কার্যক্রম আরও জোরদার করা প্রয়োজন।

অগ্রিম বিল পরিশোধের সময় ইইডির সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে ছিলেন মো. নজরুল হাকিম। তিনি বলেন, এখনো তো কাজ শেষ হয়নি। কিছু অগ্রিম বিল দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সব রিকভার হয়ে গেছে।

ইইডির সিলেট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুল আরেফিন খান বলেন, আমি কয়েকদিন আগে যোগদান করেছি। এসব কাজ হয়েছে ২০২২-২৩ সালে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।

ইইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. জালাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সিলেট জেলার বেশ কয়েকটি কাজে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এগুলো আমি দায়িত্ব গ্রহণের অনেক আগের।

অনিয়মের বিষয়ে মন্ত্রণালয় তদন্ত করেছে, বিভাগীয় ভাবেও তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদনের আলোকে বিধি মোতাবেক মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে।

আরবি/জেডআর

Link copied!