বাংলাদেশে সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের সরকারি অনুদানের বাজেট সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা আর ব্যক্তি উদ্যোগে চলচ্চিত্র নির্মাণের বাজেট সর্বোচ্চ ১ থেকে দেড় কোটি টাকা। এমন দেশে ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শতকোটি টাকা বাজেটে নির্মিত হওয়া বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্র নির্মাণে যৌথ প্রযোজনায় হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে। তবে এই লুটের অর্ধেকের বেশি করেছেন ভারতের নির্মাণসংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টরাও করেছেন তার কিঞ্চিৎ। যৌথ প্রযোজনার চুক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ৬০ ভাগ আর ভারতের ৪০ ভাগ খরচ করার কথা। ভারতের পক্ষ থেকে ৪২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে জানালেও এর কোনো হিসাবই দেওয়া হয়নি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন বিএফডিসিকে।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ অংশের খরচের ৪৪ কোটি টাকা থেকেও ভারতে শুটিংয়ের জন্য নিয়েছে ২৮ কোটি। অবশিষ্ট ১৬ কোটি টাকা থেকে দেশের শিল্পীদের পারিশ্রমিক ও হোটেল ভাড়া বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৯ কোটি। বাকি টাকা দেশে শুটিং ও বিমান ভাড়া খাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে। আর প্রেক্ষাগৃহে দর্শক টানতে এই ছবির বিজ্ঞাপন খাতেই ব্যয় দেখানো হয়েছে ২১ কোটি টাকা। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে আয় হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা সম্পূর্ণ বিনিয়োগের মাত্র দুই শতাংশেরও কম। যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ লুটের নানা তথ্য উঠে এসেছে রূপালী বাংলাদেশের দীর্ঘ অনুসন্ধানে।
বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক পরিচালনা করেন ভারতীয় পরিচালক শ্যাম বেনেগল। এতে অভিনয় করেন আরিফিন শুভ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ফজলুর রহমান বাবু, নুসরাত ফারিয়া, রিয়াজ আহমেদ, দিলারা জামান, তৌকির আহমেদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ ও জায়েদ খান। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন। আর পরিবেশকের দায়িত্ব পালন করে জাজ মাল্টিমিডিয়া। ছবিটি বাংলাদেশে মুক্তি পায় গত বছরের ১৩ অক্টোবর। আর ভারত ও যুক্তরাজ্যে মুক্তি পায় একই বছরের ২৭ অক্টোবর। ১৭৮ মিনিট স্থিতিকালের এই ছবিটি নির্মিত হয় বাংলা ও হিন্দি ভাষায়।
সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহিত করতে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের লক্ষ্যমাত্রা সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা। এর সঙ্গে প্রযোজক আর কিছু টাকা লগ্নি করে নির্মাণ করেন অনুদানের চলচ্চিত্র। এর বাইরে একজন প্রযোজকের নিজ উদ্যোগে নির্মিত চলচ্চিত্রে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ১ থেকে দেড় কোটি টাকা। অবশ্য দু’একটি ছবিতে এর চেয়ে একটু বেশিও ব্যয় হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের খারাপ অবস্থায় লগ্নিকৃত এই টাকা ঘড়ে তুলতে হিমশিম খেতে হয় প্রযোজককে। এটা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রকৃত চিত্র। এসব চিত্র হার মানিয়ে পতিত সরকারের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনী তুলে ধরতে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’।
যৌথ প্রযোজনার এই চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। এর বাইরে ছবির বিজ্ঞাপন বাজেট ছিল ২১ কোটি টাকা। বাজেটের এই অর্থের ৬০ ভাগ বাংলাদেশ আর ৪০ ভাগ ভারতের ব্যয় করার চুক্তি ছিল। প্রকৃত পক্ষে এই চলচ্চিত্র নির্মাণে ভারত কত টাকা ব্যয় করেছে, তার কোনো হিসাব দেওয়া হয়নি বাংলাদেশকে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের খরচ হওয়া ৪৪ কোটি টাকা থেকেও ২৮ কোটি নিয়েছে ভারতের ‘লাইন প্রোডিউসার’ সতীশ শর্মা। এখানেই শেষ নয়, ২৮ কোটি থেকে অবশিষ্ট ১৬ কোটির একটি অংশও ব্যয় হয় ভারতীয় শিল্পী-কুশলীদের চার্টার্ড বিমানে আনা-নেওয়া ও থাকা-খাওয়ার পেছনে। এ ছাড়া ৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বাংলাদেশের শিল্পী-কুশলীদের পারিশ্রমিকে। বাংলাদেশের লাইনম্যান প্রোডিউসার মোহাম্মাদ হোসেন জেমির বিরুদ্ধে রয়েছে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। যৌথ প্রযোজনার ক্ষেত্রে নতুন পদ সৃষ্টি করা দুই লাইনম্যান প্রোডিউসার সতীশ শর্মা ও মোহাম্মাদ হোসেন জেমির নির্দেশেই খরচ হয়েছে বরাদ্দের সব টাকা। আর এর অন্তরালে থেকে সব খরচের অনুমোদন দিয়েছেন পলাতক ফেসিস্ট সরকারের সাবেক আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন সূত্র জানায়, দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ব্যয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে আয় হয়েছে মাত্র ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা, যা সম্পূর্ণ বিনিয়োগের মাত্র এক দশমিক ৮ শতাংশ অর্থাৎ দুই শতাংশেরও কম। অথচ প্রেক্ষাগৃহে এসে ছবিটি দেখতে (দর্শক টানতে) ছবিটির বিজ্ঞাপন খাতেই ব্যয় দেখানো হয়েছে ২১ কোটি টাকা।
শতকোটি টাকায় বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক নির্মাণের বিষয়ে দেশের বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা-প্রযোজকরা ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
তারা মনে করেন, এমন একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে শ্যাম বেনেগালকে হায়ার করে আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তার চেয়ে অনেক ভালো এবং দক্ষ নির্মাতা বাংলাদেশে ছিল। তারাই এই ছবিটি বানাতে পারতেন। এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের নামে শুধু টাকা তছরুপ হয়েছে তা নয়, অনেকেই সরকারের টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
যৌথ প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাবেক মহাসচিব বদিউল আলম খোকন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নির্মাতা শ্যাম বেনেগালের বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশে অনেক খ্যাতিমান চলচ্চিত্র পরিচালক ছিলেন, যারা এই ছবিটি নির্মাণে সক্ষম ছিলেন। তাদের নির্মাণশৈলীতে ছবিটি দর্শক জনপ্রিয়তা পেতে পারত। অথচ ছবিটি নির্মাণে ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে।’
শতকোটি টাকা ব্যয় হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এমন একটি চিত্রনাট্যের গল্পে ১০৭ কোটি টাকা কোনোভাবেই খরচ হওয়ার কথা নয়। প্রকৃতপক্ষে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ ব্যয়ের বড় একটি অংশ লোপাট হয়েছে।’
অভিযোগ রয়েছে, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রটি যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হওয়ার চুক্তি থাকলেও তা ভঙ্গ করেছে ভারত। নির্মাণ ব্যয়ে বাংলাদেশের অংশের ৪৪ কোটি টাকার হিসাব পাওয়া গেলেও ভারতের অংশের ৪২ কোটি টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। কি কি খাতে ব্যয় হয়েছে, তা জানানো হয়নি বাংলাদেশকে। গতকাল শনিবার এই রিপোর্ট লেখার সময় পর্যন্ত এফডিসির অডিট বিভাগ থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশ সরকারের খরচ হয় ৪৪ কোটি টাকা। এই ৪৪ কোটি টাকা থেকে ভরতের অংশের খরচের জন্য নেওয়া হয় আরও ২৮ কোটি টাকা। বাকি ১৬ কোটি টাকা থেকে ৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় বাংলাদেশের শিল্পী-কুশলীদের পারিশ্রমিকে।
ছবিটির মূল নায়ক আরোফিন শুভ, নুসরাত ইমরোজ তিসা ও জায়েদ খান মাত্র ১ টাকা করে ৩ টাকা পারিশ্রমিক নেন। এ ছাড়া দুই দেশের শিল্পী-কুশলীদের বাংলাদেশে শুটিংয়ে থাকা-খাওয়া, ভারতীয় শিল্পী-কুশলীদের চার্টার্ড বিমানে আনা-নেওয়া এবং গাড়ি ভাড়া বাবদ ব্যয় করা হয় বাকি ৭ কোটি টাকা। ভরতীয় শিল্পী-কুশলীদের বাংলাদেশ বিমানে করে আনা-নেওয়া করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর হোটেল সোনারগাঁও, শেরাটন, হলিডে ইন ও লা-ভিঞ্চিতে থাকার খরচ বাবদ ব্যয় করা হয় ২ কোটি টাকা। বিজ্ঞাপন বাবদ ২১ কোটি টাকা খরচ দেখিয়েছে কারাগারে থাকা আসাদুজ্জামান নূর ও প্রয়াত আলী জাকেরের প্রতিষ্ঠান ‘এশিয়াটিক’। তবে এতে অনিয়ম পাওয়ায় ৩ কোটি টাকা কর্তন করে ১৮ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এফডিসি। যদিও এর আগে সাড়ে ৬ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল এই খাতে। তবে বিজ্ঞাপন খাতে এশিয়াটিকের ব্যয় নিয়ে চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তথ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রথম সারির কয়েকটি জাতীয় দৈনিক বাদ দিয়ে মাত্র ছয়টি দৈনিক পত্রিকায় বাজেটের অর্ধেক টাকার বিজ্ঞাপন দিয়ে বাকি টাকা আত্মসাৎ করে প্রতিষ্ঠানটি।
আপনার মতামত লিখুন :