আর মাত্র কয়েকদিন পরই বিদায় নিচ্ছে ২০২৪ সাল। কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে নানা ঘটনায় আলোচিত এ বছরটি। বছরজুড়ে আলোচনা-সমালোচনায় ছিল যেসব ঘটনা এরমধ্যে অন্যতম হলো-ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যাকাণ্ড। গত ১২ মে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে কলকাতায় যাওয়ার পরের দিন রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনবারের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। এরপর ২২ মে সকালে তার খুনের খবর প্রকাশ্যে এলে পুলিশ জানায়, কলকাতার উপকণ্ঠে নিউটাউনের অভিজাত আবাসন সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে আনারকে খুন করা হয়। তবে বছর শেষে এখনো রহস্যে ঘেরা এমপি আনারের হত্যাকাণ্ড।
সাবেক এমপি আনারের হত্যাকাণ্ড ছিল দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্যকর, রহস্যময় এবং নাটকীয় ঘটনা। খুনিরা আনারের মরদেহ ফ্ল্যাটের বাথরুমে টুকরো টুকরো করে দেহাংশ ফ্লাশ করে দেয়। প্রথম দিকে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কুল-কিনারা পায়নি ভারতীয় ও বাংলাদেশ পুলিশ। পরে দু’দেশের পুলিশ একত্র হয়ে এ হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে খুনিরা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার স্বীকারোক্তি দেন।
আসামিদের জবানবন্দির আগে-পরে আনারের মরদেহ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম হয়। এরপর মরদেহ শনাক্তের জন্য মরদেহের খণ্ডিতাংশের সঙ্গে তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিনের ডিএনএ টেস্ট করার জন্য সমন্বয়ে কাজ করে দু’দেশের পুলিশ। ক্লুলেস এই হত্যার ঘটনায় ডরিনের ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট মিলে যায়।
পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ পুলিশের সূত্র জানায়, ডিএনএ রিপোর্ট নিশ্চিত হওয়া গেছে খাল ও ফ্ল্যাটের পাশ থেকে উদ্ধার করা মাংস এবং হাড়গুলো বাংলাদেশের সাবেক এমপি আনারের। যা তার মেয়ের ডিএনএ টেস্টের সঙ্গে মিলছে। এর আগে ভারতের সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে দুটি নমুনাই পাঠানো হয়। সেই দুটির ডিএনএ মিলে গেছে বলে জানা গেছে। নভেম্বরের শেষ দিকে ডরিন কলকাতায় গিয়ে তার ডিএনএর নমুনা দেন। তারপর দুটি নমুনাই যাচাইয়ের জন্য পাঠানো হয় এবং গত ২০ ডিসেম্বর রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
জানা গেছে, ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা দেওয়ার জন্য আনারের স্ত্রী ইয়াসমিন ফেরদৌস ও ভাই এনামুল হককে ডাকলেও কেবল তার মেয়েই কলকাতায় যান।
দু’দেশের পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ড চাপা দিতেই পৈশাচিক পন্থা অবলম্বন করে খুনিরা। এমপি আনারের দেহ নৃশংসভাবে টুকরো টুকরো করে কেটে হাড় ও মাংস আলাদা করে হলুদ মাখিয়ে রাখে অপরাধীরা। সে কারণে এখনই তার মরদেহ পুরোপুরি শনাক্ত করতে পারেনি ভারতীয় পুলিশ। ফলে এই হত্যাকাণ্ডটি এখনো ক্লুলেস হত্যা বলে আখ্যায়িত করছে সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, এ ঘটনার আগে ও পরে বাংলাদেশে ২০২৪ সাল নানা ঘটনার কারণে আলোচিত। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ছিল ইতিহাসের অনন্য ঘটনা। অন্যান্য অঙ্গনের মতো অপরাধ অঙ্গনেও এ বছর ছিল ঘটনাবহুল। এর মধ্যে আলোচিত বেশকিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো-ফরিদপুরে মন্দিরে আগুন দেওয়ার সন্দেহে দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা: গত এপ্রিলে ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় দুই যুবককে মন্দিরে আগুন দেওয়ার সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করার পর তা দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সারা দেশে এ হত্যার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। ঢাকা ও খুলনা মহাসড়কে অবরোধ করাও হয়।
উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নে এক মন্দিরের পাশে স্কুলে নির্মাণশ্রমিকরা কাজ করছিলেন। সে সময় মন্দিরে আগুন লাগলে শ্রমিকদের অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং তাদের বেধড়ক পেটানো হয়। এ সময় দু’জন নিহত হয়। এ ঘটনার পর ফরিদপুর এক সপ্তাহেরও বেশি বিজিবি মোতায়েন ছিল।
দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙার ঘটনা: আগস্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর বেশ কিছুদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজারে হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় হতাহতেরও খবর পাওয়া যায়। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইভেন্ট খুলেও মাজার ভাঙার আহ্বান জানাতে দেখা যায়। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ মাজারে হামলার ঘটনা এবং সিলেটের শাহপরান মাজারে গান-বাজনা নিষিদ্ধ করার ঘটনা বেশি আলোচিত ছিল। গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার ভাঙার জন্য ফেসবুকে প্রচারিত একটি ইভেন্ট দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বায়তুল মোকাররমে খতিবের দায়িত্ব নিয়ে সংঘর্ষ: জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বায়তুল মোকাররমের খতিব মাওলানা মুফতি রুহুল আমীন জুমার নামাজে অনুপস্থিত থাকেন। পরবর্তীতে তিনি ফেরত এলে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) মুসল্লিদের একাংশ তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। এ সময় তার সঙ্গে আসা সমর্থকদের সঙ্গে জুমার নামাজের মুসল্লিদের সংঘর্ষ বাধে, যা বায়তুল মোকাররম মসজিদের জন্য নজিরবিহীন ঘটনা। এ ঘটনায় অন্তত দেড় শতাধিক মুসল্লি আহত হন। মসজিদে থাকা জুতার বাক্স, রড ও পাইপ দিয়ে মসজিদের গ্লাস ভাঙা এবং পরে সেসব গ্লাস দিয়ে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করার অভিযোগ ওঠে মুফতি রুহুল আমীনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। এরপর বায়তুল মোকাররমের নতুন খতিব নিয়োগ করা হয়।
এছাড়া চাঁদপুর জেলার মতলবে জুমার নামাজের বয়ানে সুদ-ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে মাওলানা রহমত উল্লাহ নামে এক ইমামকে চাকরিচ্যুত করা হলে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া এবং কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করায় চার পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়, যা এ ঘটনাকে নতুন মোড় দেয়। তবে এ চাকরিচ্যুতির ঘটনা সুদ-ঘুষ নিয়ে বয়ানের কারণে নয়; বরং এর আগে থেকেই ইমাম সাহেবকে বাদ দেওয়ার কথা ছিল বলে জানায় অভিযুক্ত মসজিদ কমিটি। তারপরও সমালোচনা হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিষয়টির সমাধান করা হয়।
ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ: বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও হাটহাজারীর পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তার হন ২৫ নভেম্বর। এর পরের দিন চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায় তার অনুসারীদের হাতে খুন হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ। চিন্ময় কৃষ্ণ দাস এক সময় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) নেতা ছিলেন এবং ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রচার চালিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি, শিশু নির্যাতনসহ চারিত্রিক স্খলনজনিত অভিযোগও বেরিয়ে আসে তার বিরুদ্ধে। এমন এক ব্যক্তিকে আইনি প্রক্রিয়ায় নিতে বাধা ও বিভিন্ন উসকানিমূলক মন্তব্য ছড়ানোর প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। সেখান থেকে ইসকন নিষিদ্ধের দাবি উঠে আসে। একই সঙ্গে আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদ এবং খুনিদের দ্রুত বিচারের দাবি করা হয়।
জুবায়েরপন্থি ও সাদপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ: বছরের শেষদিকে গাজীপুরের টঙ্গীতে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখল নিয়ে দু’পক্ষের সংঘর্ষে চারজন নিহত হন। এতে আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মুসল্লি। জানা যায়, ঘটনার দিন ভোর ৪টার দিকে তাবলিগ জামাতের জুবায়েরপন্থি ও সাদপন্থিদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
মাওলানা জুবায়ের অনুসারীদের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত গত ২৯ নভেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত জোড় ইজতেমা পালন করেন কয়েক হাজার মুসল্লি। এরপর দ্বিতীয় ধাপে আগামী ২০ থেকে ২৪ ডিসেম্বর জোড় ইজতেমা আয়োজনের অনুমতি চান ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির পক্ষের আয়োজক কমিটির (বাংলাদেশের) শীর্ষ মুরব্বিরা। তবে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে সাদ অনুসারীদের দ্বিতীয় দফায় জোড় ইজতেমার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এরপর কয়েক দিন ধরে সরকার ও মাওলানা জুবায়ের অনুসারী ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরব্বিদের কাছে দফায় দফায় জোড় ইজতেমা করার অনুমতি চান মাওলানা সাদ কান্ধলভির অনুসারী ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরব্বিরা। গত ১৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভির ইজতেমা আয়োজক কমিটির কয়েকজন শীর্ষ মুরব্বি গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপপুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে যান। সেখানে আলোচনা শেষে দুপুরে ইজতেমা ময়দানের পশ্চিম পাশ দিয়ে বিশ্ব ইজতেমা মসজিদে ফিরছিলেন সাদপন্থি মুরব্বিরা। টঙ্গীর মুন্নু গেট এলাকায় পৌঁছালে আগে থেকেই লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান করা জুবায়ের অনুসারীরা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে তাদের একটি প্রাইভেট কারে ভাঙচুর চালান। এ সময় প্রাইভেট কারে থাকা সাদ অনুসারীদের পাঁচজন আহত হন। এ ঘটনার পর থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
আপনার মতামত লিখুন :