চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে মালবাহী লাইটার জাহাজ এমভি আল-বাখেরার মাস্টার ও সুকানিসহ সেভেন মার্ডার ঘটনার তদন্ত এখনো রহস্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কী কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ হত্যাকাণ্ডকে কেউ কেউ ডাকাতি বললেও স্বজনদের দাবি, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তবে ডাকাতি নাকি পূর্ব শত্রুতার জেরে খুনের ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে এখনো নিশ্চিত নন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এ ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে খুনের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য সরকারকে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন নৌযান শ্রমিকরা। এ সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা না হলে আগামী ২৬ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর থেকে সারা দেশের নৌপথ বন্ধ ঘোষণা করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
গত সোমবার দুপুরে মেঘনা নদীর চাঁদপুরের হাইমচর এলাকায় মালবাহী লাইটার জাহাজ আল-বাখেরা থেকে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড ও নৌপুলিশ। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে আরও দুজন মারা যান। একজন বর্তমানে ঢাকায় চিকিৎসাধীন। জাহাজটিতে মোট আটজন ছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, ৯৯৯-এর মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, এমভি আল-বাখেরা জাহাজে মরদেহ রয়েছে। পরে তারা গিয়ে পাঁচজনকে মৃত অবস্থায় এবং তিনজনকে আশংকাজনক অবস্থায় পান। আহতদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুজনের মৃত্যু হয়। তবে এ ঘটনায় গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি এবং জড়িত কাউকে গ্রেপ্তারও করতে পারেনি পুলিশ।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নিহত সাতজনের লাশ নিতে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে আসেন স্বজনরা। এ সময় হাসপাতালের মর্গের সামনে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বাতাস ভারী হয়ে ওঠে মরদেহ চিহ্নিত করে নিতে আসা স্বজনদের কান্না-আহাজারিতে। দুপুরে ময়নাতদন্ত শেষে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নিহতদের মধ্যে ছয়জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. মোহসীন উদ্দিন।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের মর্গে লাশ নিতে আসা নিহত শেখ সবুজের ছোট ভাই সাদিকুর রহমান বলেন, জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া আমার মামা। তার মাধ্যমেই আমার ছোট ভাই সবুজ কাজে আসেন। তিনি লস্কর হিসেবে কাজ করেন। ঘটনার এক দিন আগে ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। যে মর্মান্তিক ঘটনায় আমার ভাই হত্যার শিকার হয়েছে, আমি চাই এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে। এই জাহাজের প্রত্যেকটি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। ঘটনাটি যাতে কেউ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা না করে আমি এটিও দাবি করছি।
একই ধরনের দাবি জানান জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়ার ভাই আউয়াল হোসেন। তিনি বলেন, এই মাসেই আমার ভাইয়ের চাকরির মেয়াদ শেষ হতো। তিনি পহেলা জানুয়ারি থেকে অবসরে যেতেন। উনার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের জানুয়ারি মাসে বিয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু এ ঘটনার পরে সব পরিকল্পনাই শেষ।
হত্যার শিকার আমিনুল মুন্সীর বড় ভাই মো. হুমায়ুন, ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিনের মামাতো ভাই জাহাঙ্গীর বলেন, ঘটনাটি আমরা ডাকাতি শুনলেও খুনের ঘটনার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত হত্যা। কারণ প্রত্যেকটি নিহতের মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাত। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন সবারই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জাহাজে পাওয়া গেছে। এমনকি জাহাজে থাকা পাঁচজনকে উদ্ধারের সময় তাদের শোয়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
এদিকে গত সোমবার নিহত সাতজনের নাম জানা গেলেও ঠিকানা জানা যায়নি। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে তাদের পুরো পরিচয় মিলেছে। নিহত সাতজন হলেন-জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া, ফরিদপুর জেলা সদরের জোয়াইর গ্রামের মৃত আনিছ বিশ্বাসের ছেলে। লস্কর শেখ সবুজ (৩৫) তারই আপন ভাগিনা। সবুজ একই গ্রামের মৃত আতাউর রহমানের ছেলে। সুকানি আমিনুল মুন্সী নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানার ইটনা ইউনিয়নের পাঙ্খারচর গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেল। লস্কর মো. মাজেদুল (১৬) মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার মো. আনিছুর রহমানের ছেলে। একই উপজেলা ও পলাশ বাড়িয়া গ্রামের লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬) দাউদ হোসেনের ছেলে। আর ইঞ্জিনচালক মো. সালাউদ্দিন (৪০) নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার লাহোরিয়া ১১ নলি গ্রামের মৃত আবেদ মোল্লার ছেলে এবং বাবুর্চি কাজী রানা (২৪) মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রামের কাজী দেলোয়ার হোসেনের ছেলে।
হাইমচর থানার ওসি মহিউদ্দিন সুমন বলেন, ঘটনার পর সাতজনেরই ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলার প্রস্তুতি চলছে।
চাঁদপুর নৌ থানার ওসি এ কে এম এস ইকবাল বলেন, তদন্ত ছাড়া এখন কিছু বলা যাচ্ছে না। আমাদের টিম কাজ শুরু করেছে। পরিবার মামলা না করলে পুলিশ মামলা করবে। যারা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।
পৃথক তিন তদন্ত কমিটি গঠন: হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক ও যুগ্মসচিবকে সদস্য সচিব করে একটি চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এ ছাড়া গতকাল চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহসীন উদ্দিন। এই কমিটি ১০ কার্য দিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করবে।
জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাঁদপুর জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায়। জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন প্রদান করতে বলা হয়েছে।
জড়িতদের গ্রেপ্তারে আল্টিমেটাম: সাত খুনে জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য সরকারকে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন নৌযান শ্রমিকরা। এ সময়ের মধ্যে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা না হলে ২৬ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর থেকে সারা দেশের নৌপথ বন্ধ ঘোষণা করা বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকরী সদস্য ও ঢাকা-চাঁদপুর লঞ্চ লেবার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হারুনুর রশিদ।
তিনি বলেন, আমাদের সাতজন সহকর্মী মারা গেছেন। আরও একজন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এ ঘটনায় আমাদের সহকর্মীদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাই প্রশাসনের কাছে আমাদের সুস্পষ্ট আবেদন, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করতে হবে। নিহতের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০ লাখ টাকা সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হবে। আর সন্ত্রাসীদের আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা সরকারকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে যেতে চাই না। কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী, আজ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হচ্ছে, এটি হতে থাকবে। পাশাপাশি আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সরকার অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হলে ২৬ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর থেকে বাংলাদেশের সম্পূর্ণ নৌপথ বন্ধ ঘোষণা করা হবে।
আপনার মতামত লিখুন :