শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২৫, ১২:৪১ এএম

দুর্নীতিতে বুঁদ ছিলেন নানক

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৭, ২০২৫, ১২:৪১ এএম

দুর্নীতিতে বুঁদ ছিলেন নানক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

ক্ষমতার শিখরে থেকে কমিশন বাণিজ্য, টেন্ডার সিন্ডিকেট, চাকরি দেওয়ার বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক প্রভাবশালী মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। গত দেড় দশকে অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন তিনি।

মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসার পরিচালনা ও নিজ নির্বাচনি এলাকার রাস্তা-ফুটপাতের চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা কামাতেন। টেন্ডার থেকে শুরু করে বরাদ্দসহ মন্ত্রণালয়ের যাবতীয় উন্নয়ন কাজে তাকে পার্সেন্টেজ দেওয়ার আলোচনা ছিল সর্বত্র। স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ছিলেন না নানক। ২০০৯ সালে পিলখানায় ৫৭ জন সেনাকর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যার ষড়যন্ত্রের অন্যতম হোতা বলেও জোরালো অভিযোগ রয়েছে। সবশেষ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালানোর নির্দেশদাতাদের অন্যতম এই আওয়ামী লীগ নেতা। ৫ আগস্টের অনেক রাঘববোয়াল ধরা পড়লেও নানকের হদিস পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গোয়েন্দা সূত্রমতে, আগস্ট-সেপ্টেবরেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। গোপন স্থান থেকেই দিচ্ছেন ভিডিও বার্তা।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার ঘনিষ্টজন নানক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী থাকাবস্থায় পার্সেন্টেজ নিয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। শেখ রেহানার লোক পরিচিত নানক দখল-চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, টাকার বিনিময়ে চাকরি দিতেন। নির্বাচনি হলফনামায় ঢাকার মোহাম্মদপুরে ৮ তলা বাড়ির মূল্য ৪৪ লাখ টাকায় দেখিয়ে আলোচনার জন্ম দেন। আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক আত্মগোপনে থেকেই ফ্যাসিস্ট দলটির হয়ে ভিডিও দিয়ে যাচ্ছেন।

স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও শেখ পরিবার এবং আ.লীগের প্রভাবশালীদের প্রমাণিত অপশাসন এবং দুর্নীতিকে পাশ কাটিয়ে বর্তমান সরকারকে নিয়ে নানা সমালোচনা করে যাচ্ছেন। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের হত্যাযজ্ঞে যারা নিহত বা আহত হয়েছেন তাদের বিষয়ে কোনো ধরনের দায় স্বীকার করছেন না।

মোহাম্মদপুরের ‘ক্রাইম জোন’ জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করতেন নানক এমন তথ্য উঠে এসেছে সরেজমিনে। নানক সিন্ডিকেটকে বাইরে রেখে ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা করা যেত না। মূলত ক্যাম্প থেকেই ঢাকার অধিকাংশ জায়গায় মাদকের সরবরাহ হয়ে থাকে।

এ ছাড়া মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, বছিলা, আদাবর শ্যামলী এলাকায় রাস্তায় চলাচলরত লেগুনাসহ অন্যান্য যানবাহন থেকে প্রতিদিন হাজার টাকার ওপর চাঁদা দেওয়া লাগত। ফুটপাতে বসা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নানক সিন্ডিকেটের সদস্যরা দিন, সপ্তাহ ও মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা নিতেন।

এককালীন লাখ টাকার বেশি দিয়ে ফুটপাতের পজিশন বিক্রি করতেন নানকের সহচররা। বর্তমানে নানকের অনুসারী রাজনৈতিক ভোল পাল্টে মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখায় চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

জাহাঙ্গীর কবির নানক ও তার স্ত্রী আরজুমান্দ বানু নার্গিসের সম্পদ ’৮ সাল থেকে ’২৪ সাল পর্যন্ত ম্যাজিকের মতো বেড়ে যায়। এমপি হওয়ার পর ১৫ বছরে ৩০ গুণ সম্পদ বেড়েছে কবির নানকের। এটা অবশ্য কেবলই তার আয়করের হিসাবে। নানকের তুলনায় তার স্ত্রীর সম্পদ বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়। তখন থেকেই নানক ও তার স্ত্রীর আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এই দম্পতির দৃশ্যমান আয়ের সঙ্গে তাদের সম্পদ অর্জনের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সম্পদের এই বিশাল বৃদ্ধি একটি অস্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, মাদক ব্যবসার টাকা দিয়েই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন নানক।

২০০৮ সালে শেখ হাসিনার ছায়াছত্রে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পান তিনি। সে সময় প্রতিমন্ত্রী হলেও, তৎকালীন মন্ত্রী আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মন্ত্রণালয়ে না আসার সুযোগ নিয়ে, তিনিই মন্ত্রির দায়িত্ব পালন করতেন। আর এভাবেই তার ভাগ্যের চাকা পাল্টাতে শুরু করে।

দায়িত্ব পালনের ৫ বছরে অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে। যেখানে টেন্ডার সিন্ডিকেটে পার্সেন্টেজ নেওয়ার জন্য বেশ সুনাম ছিল এই নেতার। নানকের অবৈধ উপার্জনের সত্যতা মেলে নির্বাচনি হলফনামা থেকেই। বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে আওয়ামী লীগের নেতা মালিক হয়েছেন শতকোটি টাকার সম্পদের। বিরোধী দলের রাজনীতি করার সময় নানকের বিরুদ্ধে নানা সময় অনেক মামলা হয়, যার বেশির ভাগ থেকেও তিনি অব্যাহতি পেয়ে যান কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া।

নানকের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও বরিশালে হত্যা এবং হত্যা প্রচেষ্টার একাধিক মামলা হয়েছে। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই পলাতক রয়েছেন নানক। তবে এবার তার অবৈধ সম্পদ ও এসব সম্পদ তৈরি করার নানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে।

যত সম্পদের মালিক: ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার দাখিল করা হলফনামায় নানক ও তার স্ত্রীর যৌথ সম্পদের পরিমাণ হিসেবে ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৫১ টাকা দেখানো হয়। এ ছাড়া ব্যবসা ও কৃষিকাজ থেকে তাদের বার্ষিক আয় ২ লাখ টাকা। ২০০৮ এর নির্বাচনের পর ৫ বছরের ক্ষমতায় যেন, আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান নানক। পরে ’১৪ সালের নির্বাচনি হলফনামায়, নানক পরিবারের সম্পদ ১০ গুন বেড়ে দাঁড়ায়। ’৮ সালে প্রায় ৬৪ লাখ টাকার সম্পদ, ’১৪ তে এসে ৬ কোটি ১৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা হয়ে যায়। সম্পদ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে স্ত্রীর চাকরি, কৃষি, মৎস্য ব্যবসাসহ আরও অনেক কিছু উল্লেখ করেন নানক।

অলৌকিকভাবে ’১৪ তে এসে আওয়ামী এই নেতার বার্ষিক আয়ও ২ লাখ টাকা থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর, দ্বাদশ নির্বাচনেও মনোনয়ন না পাওয়ায় সংসদের বাইরেই রয়ে যান নানক।

তবে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে দূরে থাকেননি এই নেতা। ছলেবলে কৌশলে অবৈধ আয় করেই গেছেন তিনি। ’২৪ এর নির্বাচনি হলফনামা অনুযায়ী, নানক ও তার স্ত্রীর সম্পত্তি ১৫ বছরে ৩০ গুন বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ১৫ হাজার ৯৫১ টাকায়। ’৮ সালে নানক কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে মাত্র ২ একর ৬৫ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন। ’২৪ সালে এসে নানক, রাজধানীর উত্তরায় ৬ তলা বাড়ি, মোহাম্মদপুরে ৮ তলা বাড়ি, কক্সবাজারে জমি, জন্মস্থান বরিশালে দুটি বাড়ি, বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় ভূ-সম্পত্তি এবং মাছের খামারের মালিক হয়ে যান। এসব কিছুর বেশিরভাগই নাকি পৈতৃক সম্পত্তি বলে দাবি করেছিলেন নানক।

হলফনামায় তথ্য গোপন: ’৮, ’১৪ ও ’২৪ নির্বাচনি হলফনামা অনুযায়ী, বহু তথ্য গোপন ও ঘাপলা করেছেন নানক। ২০০৮’র হলফনামায় কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে ২ একর ৬৫ শতাংশ জমির মালিকানা দেখান নানক। তখন অবশ্য একটি অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া আর কোনো স্থাপনার মালিকানা দেখাননি তিনি। উল্লেখ করা হয়, লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে ১০ শতাংশ এবং উত্তরায় ৩ কাঠার প্লটের মালিকানা। এর বাইরে যৌথ মালিকানায় ১০ একর জমির এক-চতুর্থাংশের মালিক বলে তথ্য দেন হলফনামায়। প্রথম দুটি জমি তার কেনা বলে জানান তিনি। যৌথ মালিকানার জমি কোথায় কিংবা তিনি ছাড়া আর কে কে মালিক তার কোনো তথ্য দেননি তখন। ’২৪ সালে এসে সম্পদের যে বর্ণনা দেন নানক তার সঙ্গে কোনো মিল নেই প্রথম হলফনামার।

২৪’র বর্ণনায় রাজধানীর উত্তরায় ৬ তলা বাড়ি, মোহাম্মদপুরে ৮ তলা বাড়ি, কক্সবাজারে জমি, জন্মস্থান বরিশালে দুটি বাড়ি, বরিশালের বিভিন্ন এলাকায় ভূ-সম্পত্তি এবং মাছের খামার মিলিয়ে ২ একর ২২ শতাংশ জমি থাকার তথ্য দেন তিনি।

এর পুরোটাই তার নিজের নামে এবং সিংহভাগ পৈতৃক সম্পত্তি। এবার যৌথ মালিকানায় থাকা জমির তথ্য চেপে যান। ঢাকার মোহাম্মদপুর এবং উত্তরায় থাকা ৮ ও ৬ তলা দুটি বাড়ির মূল্য নির্ধারণ প্রশ্নেও ঘাপলা করেন নানক। উত্তরায় ৬ তলা ভবনের মূল্য দেখানো হয় ৪ কোটি ৪২ লাখ ১২ হাজার ১৪৭ টাকা। ৪৪ লাখ ৩২ হাজার ৪০৩ টাকা মূল্য দেখানো হয় মোহাম্মদপুরের ৮ তলা ভবনের। 

আলমারিতে অন্যর বাড়ির জমির দলিল: গত ২১ আগস্ট রাতে জাহাঙ্গীর কবির নানকের মোহাম্মদপুরের বাসায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নানকের উপস্থিতির সন্দেহে বাসাটিতে নজরদারি শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর একটি দল বাসাটিতে অভিযান চালিয়ে গুরুত্বপূর্ণ নথি উদ্ধার করে।

অভিযানে আলমারি, ট্রাংকসহ বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি করে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, দলিল, ব্যাংক চেক ও বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়। অভিযানে অনেক বাড়ির দলিল পাওয়া যায়, যেগুলো অন্যের নামে। চাকরির ক্ষেত্রে তিনি এবং আওয়ামী লীগের লোকজন যে সুপারিশ করতেন, সেই প্রমাণ পায় তল্লাশিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা।

বরিশালে জমি দখল: জাহাঙ্গীর কবির নানকের বিরুদ্ধে বরিশালে জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। জমি দখল করতে না পেরে সেই জমির ওয়ারিশদের বিভিন্ন সময় মামলা করে হয়রানি করেন নানক। এ ছাড়াও পুলিশ দিয়ে প্রতিপক্ষকে অস্ত্র, ডাকাতি ও মাদক মামলার আসামি করেন নানক। গত ৩ সেপ্টেম্বর বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমন দাবি করেন ভুক্তভোগী কামরুল ইসলাম হিরণ, হারুন আকবর ও নেহার বেগম।

আরবি/জেডআর

Link copied!