ঢাকা রবিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫

নৌ সেক্টর গিলে খান খালিদ মাহমুদ

মোস্তাফিজুর রহমান সুমন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২৫, ১০:৪৪ এএম

নৌ সেক্টর গিলে খান খালিদ মাহমুদ

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও দিনাজপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গোটা নৌ সেক্টরকে গিলে ফেলেন। প্রতিমন্ত্রী হয়েই গোটা নৌপরিবহন সেক্টরকে তিনি লুটেপুটে খান। স্বজন, এপিএস ও ব্যাবসায়িক অংশীদারের নামে কিনে নিজে হন অঢেল সম্পদের মালিক। 

দিনাজপুর জেলা এবং রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলেন হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড়। নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও দলীয় পদ বিক্রি করে রোজগার করেন বিপুল অর্থ। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে স্বজনদের নামে স্বল্প সুদে কৃষিঋণ নিয়ে বানান একের পর এক অটোরাইস মিল।

 পাচার করা টাকায় লন্ডনে মেয়ের নামে কেনেন একাধিক বাড়ি। রাজধানীতে তার রয়েছে ১৩ ফ্ল্যাট এবং ৫ শতাংশ করে কয়েকটি প্লট। নিজ জেলা দিনাজপুরে রয়েছে শতকোটি টাকার বালুবাণিজ্য। তার আমলে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লুট করেছেন হাজার কোটি টাকা। 

ঠাকুরগাঁয়ের পীরগঞ্জ উপজেলার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পর লাশের গাড়িতে করে উপজেলার বৈরচুনা ইউনিয়নে পৌঁছান। এরপর ভবানীপুরের সীমান্ত দিয়ে তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে শারীরিক সৌন্দর্য- সবই যেন নজর কাড়ত আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর। শুধু তাই নয় সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রেও তার কৌশল অনবদ্য। বলা হয়ে থাকে, সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে আরব্য রজনীর রূপকথার জাদুকর ছিলেন খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। 

সম্প্রতি খালিদ মাহমুদের বেনামে অঢেল সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা ইউনিট ও দিনাজপুর জেলা কার্যালয়। দুদক গোয়েন্দা ইউনিট ও দিনাজপুর জেলা কার্যালয় তদন্তে নেমে পিলে চমকানো তথ্য পেয়েছে। 

নিজ আত্মীয়, বোনজামাই, এপিএস ও ব্যাবসায়িক অংশীদারের নামে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। অন্যদিকে, গত ২ সেপ্টেম্বর সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, তার স্ত্রী, সন্তান ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তলব করে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর খালেদ নৌপরিবহন খাত ধ্বংসের এই দানব লেজ গুটিয়ে সীমান্তপথে পালিয়ে নিজেকে রক্ষা করলেও রেখে গেছেন তার হাতে নির্যাতিত অসংখ্য দলীয় কর্মী। 

তার দাদা মৌলভী খোরশেদ আলেমের পুত্র সাবেক এমপি-মন্ত্রী আবদুর রৌফ চৌধুরীর পুত্র খালিদ মাহমুদ দখল বাণিজ্য আর টাকা লুটপাটের সময় নিজ দলের লোকজনকে কুকুরের মতো পেটাতেও কার্পণ্য করেননি। তার পেটুয়া বাহিনীর প্রধান আবুল বাশারকে দিয়ে গোটা দিনাজপুর, বিরল ও বোচাগঞ্জে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। 

পিয়ন হোক আর ঝাড়ুদার হোক, ২০ লাখ টাকার নিচে কোনো নিয়োগ বাণিজ্য করেননি তিনি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২৫ থেকে ৩৫ লাখ টাকা যার কাছে থেকে পেয়েছেন, তিনিই নির্বাচিত হয়েছে চেয়ারম্যান। কেউ প্রতিবাদ করলেই তার ওপর চলত নির্যাতন, মৃত্যুর হুমকি এবং সর্বশেষ মাদকসহ নানান মামলায় যেতে হতো জেলে।

প্রতিমন্ত্রী হাজার কোটি টাকা লন্ডনে পাচার করেছেন তার একান্ত সচিব (এপিএস) বাশারের মালিকানায় নেওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার মাধ্যমে। প্রতিমন্ত্রীর মদদে বোচাগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ফেনসিডিল ও টাপেনটাডল নামের মাদক চোরাচালানের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী তুহিন। 

গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের সঙ্গে আত্মগোপনে চলে যান খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তার সঙ্গে আত্মগোপনে গেছেন তার একান্ত অনুসারীরাও।

জোছরা অটোরাইস মিলের মালিক আবদুল হান্নান ম্যানেজারের নামে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। ওই সব জমির কয়েক গুণ বেশি দাম দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে বন্ধক রেখে খালিদ মাহমুদের প্রভাবে শতকোটি টাকার লোন তুলেন আবদুল হান্নান। 

এ ছাড়া প্রতিমন্ত্রীর বেনামে ঢাকার লালমাটিয়া, আদাবর, শেখেরটেক, মোয়াম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটি, বাবর রোড ও হুমায়ুন রোডে রয়েছে ১৬টি ফ্ল্যাট এবং বছিলা ও ঢাকা উদ্যানে ৫ শতাংশ করে ১০টি প্লট। নৌপরিবহন খাতকে ধ্বংসের সীমায় নিয়ে যাওয়া এই মাফিয়া ডন তার মরহুম বাবার নামে করা রৌফ ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের নামেও ভাঁওতাবাজি করে কবরস্থানের জমি দখল ও অর্থবাণিজ্য করেছেন।

দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম জানান, ওই প্রতিমন্ত্রীর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান আছে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুদক জানতে পারে, প্রতিমন্ত্রী হাজার কোটি টাকা লন্ডনে পাচার করেছেন সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) বাশারের মালিকানায় নেওয়া এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার মাধ্যমে। 

প্রতিমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় বোচাগঞ্জ উপজেলার সীমান্ত এলাকায় ফেনসিডিল ও টাপেনটাডল নামের মাদক চোরাচালানের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী তুহিন। 

তবে ২০১৮ সালে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পরই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) প্রধান কার্যালয় নিয়ন্ত্রণে রাখতেন এপিএসের মাধ্যমে। নিজস্ব ঠিকাদার ও ব্যক্তিগত ক্যাডার বাহিনী নিয়ে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে প্রবেশ করে বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীদের কক্ষে গিয়ে এপিএসের মাধ্যমে কাজ দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করতেন। 

অপছন্দের ঠিকাদারকে বিআইডব্লিউটিএ ভবনে প্রবেশ করতে দিতেন না। ২০ লাখ টাকার ওপরে যেকোনো কাজে কমিশন দিতে হতো প্রতিমন্ত্রীর লোকদের। কমিশন না দিলে কাজ পাওয়া যেত না। এসব কাজে এপিএসের বড় সহযোগী ছিলেন প্রতিমন্ত্রীর চাচাতো ভাইয়ের শ্যালিকার স্বামী মো. আরশাদ। 

এই দুজন মিলে নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রণালয়ের সবকিছু। তাদের মাধ্যমেই কাজের পারসেন্টেজ নিতেন প্রতিমন্ত্রী। কাকে কাজ দেওয়া যাবে, তা ঠিক করতেন আরশাদ আর বাশার।

 বিআইডব্লিউটিএ, বিআইডব্লিউটিসি, চট্টগ্রাম বন্দর, পায়রা পোর্টের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী পদে নিজেদের সিন্ডিকেটের লোক বসাতেন ওই দুজন। তাদের মধ্যে আরশাদ নৌ প্রতিমন্ত্রীর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন সবার কাছে। মূলত এই আরশাদই প্রতিমন্ত্রীর হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, প্রতিমন্ত্রী দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় এপিএস বাশারের মাধ্যমে টেনা গ্রামে নামে-বেনামে ৩০০ বিঘা জমি কেনেন। এ ছাড়া কালুপীর বাজারের পাশে মসলাবাটি নামক স্থানে ১৫০ বিঘার ওপর পুকুরের সঙ্গে করেছেন খামারবাড়ি। 

কালুপীর বাজারে কয়েক কোটি টাকার জমি, দোকান ও গোডাউন করেছেন। পার্শ্ববর্তী উপজেলা পীরগঞ্জের ৫ নম্বর সৈয়দপুর ইউনিয়নে ৯০ বিঘা জমির ওপর আমবাগান, পীরগঞ্জ উপজেলায় কয়েক কোটি টাকা মূল্যের ৫৮ শতাংশ জমি, বোচাগঞ্জের সেতাবগঞ্জ বাজারে কয়েক কোটি টাকার ১ হাজার ৭৪১ শতাংশ জমি, বিরল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রমাকান্তের মাধ্যমে স্থলবন্দরের পাশেই ৩৮৬ শতাংশ জমিসহ শত শত কোটি টাকার বালুবাণিজ্য রয়েছে।

 দিনাজপুর শহরে পাঁচটি প্লট রয়েছে। জেলার পুনর্ভবা নদী থেকে প্রতিমন্ত্রীর অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণে ছিলেন রমাকান্ত। 

এ ছাড়া জোহুরা অটোরাইস মিলের মালিক আবদুল হান্নান তার একাধিক ম্যানেজারের নামে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। ওই সব জমির কয়েক গুণ বেশি দাম দেখিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকে বন্ধক রেখে খালিদ মাহমুদের প্রভাবে শতকোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন আবদুল হান্নান।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!