দেশের বেশির ভাগ মানুষ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সমাজে চলাফেরা করতে চান। সাধারণ মানুষের দাবিÑ রাজনৈতিক বুলিংয়ের শিকার হয়ে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে তাদের। এ কারণে তারা দেশের রাজনীতিতে সংস্কারের দাবি তুলেছেন। যাতে করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করা না হয়।
সংবাদিক, পুলিশ, চিকিৎসক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছেন এমপি-মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা। তাদের কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ বা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। যারা দেশ ছেড়েছেন বা আত্মগোপনে রয়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনরা ও পরিবারের লোকজন রাজনৈতিক বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি মাঠে থাকা একটি বড় দলের নেতাকর্মীরা রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধের কারণে ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পরিবারকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, দেশে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ রাজনীতির বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ খুবই বাজেভাবে রাজনীতির অঙ্গন থেকে ছিটকে পড়েছে। এ থেকে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো যদি শিক্ষা গ্রহণ না করে তাহলে ভবিষ্যতে তাদেরও পস্তাতে হবে। তারা বলছেন, আমাদের দেশের মানুষ দু-একটা রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরশীল, দেশের অনেক মানুষ আছে যারা কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। তবুও তাদের রাজনৈতিক বুলিংয়ের শিকার হতে হয়। এ কারণে সাধারণ মানুষ মানসিক চাপে থাকেন এবং অনেকেই ভেঙে পড়েন। এর থেকে মুক্ত হতে হলে দেশে স্বচ্ছ রাজনীতির বিকল্প নেই।
রাজনীতি না করেই সাধারণ কর্মজীবী এস এম হাসান রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, চার সদস্যের পরিবারে উপার্জন করা একমাত্র ব্যক্তি আমি। আমার ছোট একটি ভাই রয়েছে। খুবই স্বাভাবিকভাবে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে আমাদের মাঝে বনিবনা না হওয়ায় সে স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের একজনের শরণাপন্ন হয় বিষয়টি সমাধানের জন্য। আমরা দুই ভাই চেয়েছিলাম তার বিচক্ষণতা অনুসারে আমাদের সমস্যা যেন সমাধান হয়। তিনি সবকিছু শুনলেন, বুঝলেন এবং সমাধান না দিয়ে, ঝামেলাযুক্ত ওই জমিটি তার কাছে বিক্রি করে অর্থ দুই ভাইয়ের মাঝে ভাগাভাগি করে নিতে বললেন। বাজার মূল্য থেকে অনেকটা কম হওয়ায় এবং পিতার রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি আমরা বিক্রি করতে রাজি না। কিন্তু তিনি তার দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অত্যন্ত কম মূল্যে আমাদের কাছ থেকে জমিটি ছিনিয়ে নেন। যেটা সামাজিকভাবে আমাদের আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকটা নিচে নামিয়ে দিয়েছে। কারণ জমিটি ছিল আমাদের ফসলের এবং আয়ের সিংহ স্থল। শুধু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আমাদের থেকে উনি জায়গা ছিনিয়ে নেন। তার প্রভাব এবং রাজনৈতিক অপশক্তির কাছে আমরা পরাস্ত হই। রাজনৈতিক এমন অপশক্তির কাছে পরাস্থ হয়েছে গ্রামের অনেকেই। আমরা এই রাজনৈতিক জটিলতা থেকে মুক্তি চাই এবং সহজ নিষ্ঠাপূর্ণ একটি সামাজিক ব্যবস্থার দাবি করছি সরকারের কাছে।
রাজনৈতিক বুলিংয়ের শিকার হওয়া শিক্ষার্থী হিমালয় জানান, ছাত্রজীবন হলো শিক্ষা অর্জন ও চরিত্র গঠনের সময়। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা ও নৈতিকতার পথে বাধা সৃষ্টি করছে। রাজনীতির অপব্যবহারে ছাত্ররা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে এবং সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ছে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং মেধাবীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটছে। রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক ছাত্র তাদের স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার হওয়া ছাত্র রাজনীতি শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, সমাজ ও জাতির জন্যও হুমকি। তাই এই রাজনীতির ভালো দিকগুলোকে গ্রহণ করতে চাইলেও খারাপ প্রভাবগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। শিক্ষা, নৈতিকতা এবং ব্যক্তিত্ব উন্নয়নই ছাত্রজীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। তবে আমি এটাই বলতে চাই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি থাকুক তবে সেটার জন্য যাতে আমার মতো সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক জটিলতায় না পড়ে। যদি সেটা না হয় তাহলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জীবনযাপন চাই আমরা।
সংবাদকর্মী সোনিয়া আক্তার জানান, রাজনৈতিক প্রভাব আমাদের সামাজিক জীবনে নানা সংকট সৃষ্টি করছে। মতাদর্শের পার্থক্যের কারণে আমি অনেক পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখেছি। পারিবারিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধনে ফাটল ধরতে দেখেছি। পাশাপাশি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের জন্য বৈষম্য, বিদ্বেষ ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হতে হয়, যা মানসিক চাপ ও সামাজিক অবস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি আমি আমার শিক্ষাজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসবাস করা আমার সহপাঠী ও জুনিয়রদের ভিন্ন মতের ছাত্রীদের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক হেনস্তার শিকার হতে দেখেছি। এমনকি নিজের সম্মান রক্ষার্থে অন্যদের নির্বাক চেয়ে দেখা এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃপক্ষের নিরবতায় বারবার হতাশ হয়েছি। আমার দেশে আমি আর কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতার বল প্রয়োগ দেখতে চাই না। তাই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ হোক রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠুক আপন মতাদর্শ নিয়ে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) গোলাম রসুল জানান, ‘জনবান্ধব পুলিশ গঠনে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা আমাদের চিন্তার সঙ্গে মিলে গেছে। তারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ চায়। আমাদের একটি জরিপের সুপারিশে আসা জনমতের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রেখে কাজ করছি।’
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা যেমন দরকার তেমনি দরকার রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতা। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা যদি জবাবদিহিতার মধ্যে থাকতো তাহলে এ দেশের এই করুণ অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো না। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হতো না। দেশ পরিচালনার জন্য রাজনীতির দরকার আছে। এজন্য দরকার জবাবদিহিতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা না থাকায় আজ সাধারণ মানুষ জীবনযাপনে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তি চাইছে।
মিরপুরে কর্মরত ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সোহাগ রানা বলেন, সব ক্ষেত্রে রাজনীতি থাকলে সেটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে প্রভাব বিস্তার করে। যাতে স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। সেই স্থান থেকে মনে করি- সবকিছু সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত করা উচিত নয়। আমরা এখন কর্মজীবনে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চাই।
তরুণ গণমাধ্যমকর্মী এফ এ শাহেদ বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের ভিতর ‘পাওয়ার প্র্যাকটিসের’ প্রবণতা দেখা যায়। বাংলাদেশে সে প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। তবে, কোনো মানুষই রাজনীতির বাইরে নয়। সবাই কোনো না কোনো আদর্শে বিশ্বাসী। জুলাই অভ্যুত্থানের পর সরাসরি রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ছাড়া, সাধারণ সব মানুষ এখন চান রাষ্ট্রের সবকিছু ঢালাওভাবে রাজনীতিকরণ না হোক। দেশের সবার সমতার-অধিকার নিশ্চিত করতে, সবকিছুতেই রাজনীতির প্রভাব থাকা যৌক্তিক নয়।
এসব বিষয়ে রিস্টার্ট সাইকোলজিক্যাল কনসালটেন্সি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড অর্গানাইজেশনাল সাইকোলজিস্ট ডা. এম এ আল মামুন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জীবনযাপন চান। এর কারণ হলো আমাদের দেশে অনেক মানুষ রাজনৈতিক কোলাহলের শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন, যার প্রভাব সামাজিক ও পারিবারিকভাবে পড়ে। এর থেকে মুক্ত হতে হলে সুষ্ঠু রাজনীতির চর্চা আমাদের জরুরি। অন্যথায় নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারবে না। তা ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সাধারণ মানুষ মানসিক চাপে থাকেন এবং অনেকেই ভেঙে পড়েন। এর থেকে মুক্ত হতে হলে দেশে স্বচ্ছ রাজনীতির বিকল্প নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেছেন, জনমত জরিপে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জীবনযাপন চান কেন? এর পেছনে অনেক কারণই আছে। দেখা গেছে, অনেক সময় কোনো বংশ বা পরিবারের কেউ রাজনীতিতে যুক্ত হলে বা ক্ষমতায় থাকলে সে অন্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তির ক্ষমতা পড়ে গেলে তিনি আত্মগোপনে বা রাজনৈতিক মাঠ থেকে হারিয়ে যান। এরপর ওই ব্যক্তির পরিবারটি প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক বুলিংয়ের শিকার হন। এ জন্য সব রাজনৈতিক দলের অপকর্ম থেকে দূরে থেকে নিজেকে জনসেবী হিসেবে তৈরি করতে হবে। সেটা না হলে ক্ষমতার রদবদলের ফলে পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা বাজেভাবে প্রভাবিত হতে হয়। যে কারণে সাধারণ মানুষ এখন সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে সামাজিক জীবনে বা পারিবারিক জীবনে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত জীবনযাপন চান।
আপনার মতামত লিখুন :