ঢাকা রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫

জনগণের মরণদশা

রহিম শেখ

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১২, ২০২৫, ১২:১০ এএম

জনগণের মরণদশা

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দুই মাসের মাথায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার। রেখে যায় একটি অর্থবছর। সেই অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে হুট করে শতাধিক পণ্য ও সেবায় মূল্য সংযোজন কর বা (ভ্যাট) বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই কঠিন সময়ে দেশের মানুষের ওপর বাড়তি করের বোঝায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি ট্রাকে করে টিসিবির পণ্য বিক্রি বন্ধ হওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দল ছাড়াও অর্থনীতিবিদ ও ভোক্তারা সরকারের এই পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছেন। সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া না হলেও অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, রাজস্ব আদায়ে ধস নামার প্রভাব ঠেকাতে এবং আইএমএফের কাছ থেকে অতিরিক্ত ১ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার জন্যই সরকার ‘কর আদায়ের এই সহজ পথ’ বেছে নিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পাশ করে গেলেও অভ্যুত্থানে এক মাস পরই তাদের পতন ঘটায় বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। ঘোষিত বাজেটে গোটা অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। প্রথম পাঁচ মাস, অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। ফলে পাঁচ মাসেই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। তবে তা আদায় করতে না পারায় সংশোধিত বাজেটে এই লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার কোটি টাকা কমানো হয়েছিল। কিন্তু এবার অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসেই ঘাটতি তার দ্বিগুণ হওয়ায় পুরো বছর শেষে ঘাটতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সরকারের চিন্তার জন্য যথেষ্ট। এই ঘাটতি পূরণে অর্থবছরের মাঝপথে এসে বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় ভ্যাট শুল্ক ও আয়কর বাড়ানোর পথে হাঁটল অন্তর্বর্তী সরকার।

গত বৃহস্পতিবার রাতে এ-সংক্রান্ত দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অধ্যাদেশ দুটি হলো মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫। এ দুটি অধ্যাদেশ জারির পর এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করে। এর ফলে এই অধ্যাদেশের পরিবর্তনগুলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে। এর আগে গত ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির এনবিআরের প্রস্তাব পাশ করা হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে। জাতীয় সংসদ না থাকায় অধ্যাদেশের মাধ্যমে শুল্ক-কর বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

যদিও অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক এখন মূল্যস্ফীতি। সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ।

আগের মাস নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। ডিসেম্বরে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতির অর্থ হলোÑ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, গত বছরের ডিসেম্বরে সেই একই পণ্য বা সেবা পেতে ১১০ টাকা ৮৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে বলেছে। সে কারণে অর্থবছরের মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ করের বোঝা বাড়ানোর পথে হেঁটেছে সরকার।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণের অনুমোদন দিয়েছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ। এই ঋণের তিন কিস্তির টাকা এরই মধ্যে ছাড় করা হয়েছে এবং চতুর্থ কিস্তির টাকাও দ্রেয়া হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। কিন্তু এরই মধ্যে আইএমএফের কাছ থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আরও এক বিলিয়ন ডলার সহায়তা চাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

তবে পরিস্থিতির উন্নতি হোক আর না হোক, আইএমএফের সঙ্গে সরকারের যে ঋণ চুক্তি, তাতে করে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি অনুপাতে কর সংগ্রহ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্ট বাড়াতে হবে। 

বিশ্লেষকদের মতে, আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দরকষাকষিতে অদক্ষতার কারণেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ সরকারকে নিতে হয়েছে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী সরকারকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। গত কয়েক বছর সরকার এটি পারেনি এবং সেজন্যই মনে হয় এখন সরকার একটি সহজ পথ বেছে নিয়েছে।

রাজধানীর বনশ্রীতে বাস করেন গৃহিণী রোকেয়া বেগম। তিনি বলেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। ওষুধের দাম গত তিন বছর ধরে বেড়েই চলেছে। আর কত বাড়াবে এর দাম? অবশ্য ভ্যাট বা কর বাড়ানোর সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে গত ২ জানুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়লেও জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। তখন তিনি বলেছিলেন, জরুরি পণ্যের শুল্ক কমিয়ে ‘শূন্য’ করা হয়েছে। জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তাফিজুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আইএমএফের ঋণের প্রথম তিন কিস্তির সময় রাজস্ব বাড়ানো বা কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে যে শর্ত ছিল, বাংলাদেশ তা পূরণ করতে পারেনি। ফলে এবার সংস্থাটি আরও চাপ বাড়িয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এখন সরকার আরও এক বিলিয়ন ডলার চাইছে। ফলে আইএমএফও আরও শক্ত করে চাপ দিচ্ছে। এ কারণেই এভাবে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী শুল্ক বা ভ্যাট এভাবে না বাড়িয়ে সরকার আর কী পদক্ষেপ নিতে পারত জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার প্রত্যক্ষ কর বাড়ালে এবং কর ফাঁকি রোধে উদ্যোগী হলে সাধারণ মানুষের ওপর এই চাপ তৈরি করতে হতো না। এখন সুযোগ ছিল টিআইএন নম্বরধারীদের রিটার্ন সাবমিট নিশ্চিত করা এবং করযোগ্য যারা করের আওতার বাইরে আছেন, তাদের করের আওতায় নিয়ে আসার। কিন্তু সেই কাজে উদ্যোগী না হয়ে সরকার সহজ পথ বেছে নিয়েছে।

ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি।

সংগঠনটি বলেছে, ভ্যাটের হার আগের মতো ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা না হলে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরা প্রথমে মানববন্ধন করবেন। তাতে কাজ না হলে সারা দেশে এক দিনের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখা হবে। এর পরও কাজ না হলে চূড়ান্ত পর্যায়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হবে। ভ্যাট ও শুল্ক বৃদ্ধির অধ্যাদেশ এবং টিসিবির ট্রাক সেল কর্মসূচি বন্ধের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাবে জাতীয় নাগরিক কমিটি। 

আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার: শুল্ক ও করহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এবং শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির উদ্যোগ অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। গতকাল শনিবার ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের সমসাময়িক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক উপস্থাপনকালে সংগঠনটির সভাপতি তাসকীন আহমেদ এমন মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ অর্থনীতির ১১টি বিষয়বস্তুর ওপর বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি ২০২৫ সালে ডিসিসিআইয়ের কর্মপরিকল্পনার ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সংকটময় মুহূর্ত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার মূল কারণ হলো সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি ব্যয়, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণপ্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতাসহ উচ্চ সুদহার।

তাছাড়া বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতির বিদ্যমান এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু পণ্যের করহার বৃদ্ধি এবং শিল্পে গ্যাসের মূল্য দ্বিগুণের বেশি বাড়ানোর উদ্যোগ আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ডিসিসিআই সভাপতি জানান, বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, উচ্চ জ্বালানি ব্যয় ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানিপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণপ্রাপ্তিতে বাধা ও সুদের উচ্চহার, উচ্চ শুল্কহার, ভ্যাট হার বৃদ্ধি এবং সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে দেশের বেসরকারি খাত এমনিতেই বেশ চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে।

ভ্যাট অধ্যাদেশ প্রত্যাহার, টিসিবির ট্রাক সেল চালু চায় নাগরিক কমিটি: ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়া দুধ, মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় শুল্ক, কর, ভ্যাট বাড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা দুটি অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। একই সঙ্গে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ট্রাকে করে ভর্তুকিমূল্যে পণ্য বিক্রির বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রক্রিয়া ফের শুরু করার কথাও বলছে দলটি। এছাড়া আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের চুক্তির শর্ত পুনর্বিবেচনা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে। গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর বাংলামোটরে কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানান সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

আরবি/জেডআর

Link copied!