ঢাকা শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
অর্থ পাচার

খলনায়ক ধরতে মাঠে নামছে পুলিশ

মেহেদী হাসান

প্রকাশিত: আগস্ট ৩০, ২০২৪, ০১:০৯ এএম

খলনায়ক ধরতে মাঠে নামছে পুলিশ

ছবি: সংগৃহীত

 

ঢাকা: কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত দেশের অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম পানামা এবং প্যারাডাইস পেপারসে প্রকাশিত হয়েছে। তথ্য প্রকাশের পর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন কারণে তা থমকে থাকলেও নতুন করে তা গতি পেয়েছে।

আওয়ামী সরকার পতনের পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর লুটেরাদের সম্পদ না কেনার বার্তা দেন। গভর্ণরের সেই হুঙ্কারের পর আরো শক্ত অবস্থান নিয়েছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি)। ব্যাংক খাতের দুর্নীতি এবং অর্থ পাচারে জড়িত খলনায়কদের ওপর কঠোর দৃষ্টি রাখছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। শিগগিরই তাদের আটকে অভিযানে নামবে বলে জানিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থাটির বিশেষ একটি সূত্র।

এদিকে, দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ৬ গ্রুপের অর্থ পাচারের তথ্য জানতে একাধিক দেশে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আর্থিকখাত কেলেঙ্কারি দায়ে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপের না শীর্ষে রয়েছে। আরো রয়েছে সামিট, বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ওরিয়ন গ্রুপসহ আরও একটি স্বনামধন্য গ্রুপ। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের সাইফুল আলম, সামিট গ্রুপের আজিজ খানসহ আরও কয়েকজনের অর্থ পাচারের আংশিক তথ্য রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। আপাতত ৬টি গ্রুপের ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য চেয়ে একাধিক দেশে চিঠি দিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিভাগ।

তথ্য পাওয়ার পর আইনি ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে আর্থিক এই গোয়েন্দা ইউনিট বিভাগ।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের হাতে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে কী পরিমাণ অর্থ বের করা হয়েছে, তা যাচাইয়ের কাজ চলছে।

সিআইডি থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, দেশ থেকে বছরে ৮৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। তবে ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি শুরু হলে হুন্ডি ব্যবসায় ধস নামে। সেজন্য প্রায় দুই বছর বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসে। করোনাকাল ২০২০ এবং ২০২১ সালের আগস্ট মাসের হিসাব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম দিক থেকেই করোনা মহামারির প্রকোপ কমলে হুন্ডি ব্যবসা আবার চাঙ্গা হয়, ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে।

২০২০-২১ অর্থবছরে তা আরো কমে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। যা শতকরা হিসেবে ১৫ শতাংশ কম। শুধু হুন্ডির মাধ্যমেই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে আরও নানা উপায়ে দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়েছে।

সিআইডি জানায়, দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার রয়েছে। অস্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশে ব্যাংকের দেখভাল বা শুদ্ধাচারের অভাবে এসব মানি এক্সচেঞ্জারদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করছে দুষ্কৃতিকারীরা।

সরকার পরিবর্তনের পরে অর্থ পাচার প্রতিরোধে অন্তর্বর্তী সরকার শক্ত অবস্থান নেয়ায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। নতুন করে পাচার ঠেকাতে হুন্ডিচক্র ও কর ফাঁকির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে বলে জানিয়েছে সিআইডির বিশেষ একটি শাখা। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) একটি দল বেশ কয়েকজন অর্থ পাচারকারীদের নজরে রেখেছেন। তাদের ধরতে যে কোন সময় অভিযান শুরু হবে।

সিআইডির এমন প্রস্তুতির আগে দেশের বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। এ জন্য এস আলমের সম্পদ কাউকে না কেনার আহ্বান জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, এস আলম ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি, যিনি সুপরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছেন। এমন সুপরিকল্পিতভাবে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছে কি না, তা জানা নেই।

তার আগে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আরো কঠোর বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালীরা কত টাকার ঋণ আত্মসাৎ করেছেন তার হিসাব করা হচ্ছে। অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিচারের প্রতি সরকারের কঠোর মনোভাবের ইঙ্গিত করে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে বলা হয়, ব্যাংকসমূহের নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইউই, সিআইডি ও দুদকের সহায়তা নিয়ে আত্মসাৎকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ ও বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে কাজ শুরু হয়েছে। অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা চেয়ে ইতোমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছে সরকার।

সরকারের এমন ঘোষণার পর নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, অর্থ পাচার প্রতিরোধ করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বর্তমান সরকার। যার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাকে। কিন্তু এখনো কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তদের আইনের আওতায় এখনো পুরোপুরিভাবে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

পাচার সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, বিগত সরকারের সময় অর্থ পাচারের ঘটনা বেড়েই চলছিল। আশা করি এখন অনেক কমে যাবে। অনেক সময় দেখা গেছে গোয়েন্দা বাহিনী পাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে ঢালাওভাবে প্রচার করেছে। তবে এতে তেমন কোনো ফল আসছে না। সর্তক হয়নি পাচারচক্র, তারা নির্মূলও হয়নি। তাই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে, তবেই প্রতিরোধ করা অনেকটা সম্ভব।

না প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, অর্থ পাচারকারীরা দেশের শত্রু, তাদের আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি। এ বিষয়ে কোনো ছাড় নয়। এসব বিষয়ে নতুন সরকার, দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাদের গুরুত্বের সঙ্গে পদক্ষেপ নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে সিআইডির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) অবৈধ হুন্ডিচক্র, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে। এসব বিষয়ে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। যেমন কঠোর অবস্থানে সরকার, ঠিক তেমন সিআইডি ও কঠোর অবস্থানে থেকে এসব প্রতিরোধে কাজ করবে।

গোয়েন্দা তথ্য জানায়, সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) একটি দল বেশ কয়েকজন অর্থ পাচারকারীদের নজরে রেখেছে। তাদের ধরতে যে কোন সময় অভিযান শুরু হবে। এমএফএসের তথ্যের ভিত্তিতে হুন্ডির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করতে সরকারি বিভিন্ন বাহিনী।

সূত্রমতে, রেমিট্যান্সের ওপর রিজার্ভ পরিস্থিতি অনেকটা নির্ভরশীল। চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়লে স্বস্তিও বাড়বে। এসব কারণ বিবেচনায় নিয়ে অবৈধ পথে আয় উপার্জন কারীদের বিরুদ্ধে নানামুখী উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। এজন্য হুন্ডিচক্র ও পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে আসছে নতুন অভিযান।

অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে, প্রাথমিকভাবে সেসব দেশে এবং পরবর্তী সময়ে অন্যত্র সুবিধামতো জায়গায় স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে দেশের অর্থনীতির বিষফোঁড়া হলো অর্থ পাচার।

সিআইডি বলছে, অর্থ পাচার রোধে যার যার অস্থান থেকে সর্তক থাকতে হবে। তাছাড়া ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জার রয়েছে দেশে। এসব মানি এক্সচেঞ্জারদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করছে দুষ্কৃতিকারীরা। তবে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে অর্থ পাচার প্রতিরোধের বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে বেশ কিছু সফলতাও আস্তে শুরু করেছে।

আরবি/জেডআর

Link copied!