ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর, ২০২৪

ওসমানী বিমানবন্দর প্রকল্পে পুকুর চুরি

মাইনুল হক ভূঁইয়া ও দেলোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: নভেম্বর ৫, ২০২৪, ০১:৪৩ এএম

ওসমানী বিমানবন্দর প্রকল্পে পুকুর চুরি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পে পুকুর চুরির ঘটনা ঘটেছে। মাত্র ২২ শতাংশ কাজ শেষ হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপকে ইতিমধ্যে অগ্রিম দেওয়া হয়েছে ২১২ কোটি টাকা।

এদিকে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা গরমিল হওয়ায় অডিট থেকেও আপত্তি উঠেছে। দুর্নীতি-অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় প্রকল্প পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে প্রত্যাহার করে নতুন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই নতুন প্রকল্প পরিচালকও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। ফলে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন এখন পুরোপুরি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেওয়ার জন্য দুই হাজার ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটিতে পদে পদে অনিয়ম হয়েছে। কাজ শুরুর পর থেকেই প্রকল্পটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বারবার বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ, বাড়ছে ব্যয়ও। এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র সাড়ে ২২ শতাংশ। কাজের অগ্রগতি না হওয়ায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও বেবিচকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করছেন। এ অবস্থায় সময়মতো এ প্রকল্প শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ মূল্যায়ন বিভাগের প্রতিবেদনে কাজের অগ্রগতি না হওয়া এবং অন্যান্য অসঙ্গতি উঠে এসেছে। এ ছাড়া তাদের নিরীক্ষায় দুটি বিষয়ে এক কোটি ৩৫ লাখ টাকার অডিট আপত্তি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক মইদুর রহমান মো. মওদুদ জানান, প্রকল্পের কাজ সাড়ে ২২ শতাংশ শেষ হয়েছে। ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে। ২০২৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য রয়েছে। শেষ হবে কি না সেটা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

অভিযোগ উঠেছে, কাজ শুরুর আগেই ইকুইপমেন্ট মোবিলাইজেশন বাবদ অগ্রিম ২১২ কোটি টাকা নিয়ে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বেইজিং আরবান কনস্ট্রাকশন গ্রুপ (বিইউসিজি)। এ ছাড়া নকশার ত্রুটির পেছনে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও তা নেওয়া হয়নি। বলা হচ্ছে, প্রকল্পের টাকা লোপাটের উদ্দেশ্যেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জ্ঞাতসারে নকশায় ত্রুটি রেখেছিলেন। ফলে শুরুতেই প্রকল্পের কাজ থমকে যায়। বিমান মন্ত্রণালয় থেকে এই ত্রুটিপূর্ণ নকশা প্রণয়ন ও পরামর্শকের কাছ থেকে যথাযথভাবে বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নামের তালিকা চাইলেও তা পাঠায়নি বেবিচক। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রক্রিয়ায় জড়িত তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বহিঃবিমানবন্দর) ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (প্ল্যানিং অ্যান্ড কিউএস) নামসহ প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল মালেক। কিন্তু তা পাঠানো হয়নি।

অন্যদিকে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিইউসিজি অভিযোগ করেছে, ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার সিভিল ডিভিশন-৩-এর অধীনে কাজটির তত্ত্বাবধান করা হয়। এই ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের গাফিলতিতেই প্রকল্পটির যথাসময়ে বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ বিষয় উল্লেখ করে বেবিচককে একাধিক চিঠি দিয়েছে বিইউসিজি।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর দুই হাজার ১১৬ কোটি টাকার এই প্রকল্প অনুমোদন পায়। প্রকল্পের আওতায় এখানে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ফুয়েলিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক মানের টার্মিনাল ভবন নির্মাণ, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পৃথক সাব-স্টেশন স্থাপন, নিরাপত্তার জন্য ফায়ারফাইটিং সিস্টেম ও যাত্রীদের জন্য এস্কেলেটরসহ আনুষঙ্গিক কিছু কাজ রয়েছে। এই মেগাপ্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয়, শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২২ সালে। পরে ২০২৩ সালের ২৭ মে এবং সর্বশেষ ২০২৫-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

জানা গেছে, নকশায় ত্রুটিসহ বিভিন্ন ধরনের গাফিলতির অভিযোগে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাবিবুর রহমানকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়। বর্তমানে তাকে ফ্লাইট সেফটি বিভাগে পদায়ন করা হয়েছে।

আইএমইডির পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিপিপিবহির্ভূতভাবে গাড়িভাড়া দেখিয়ে বিল পরিশোধ করায় ৬৪ লাখ ৬০ হাজার ১০৭ টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া বিধিবহির্ভূতভাবে ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করায় ৬৯ লাখ ২৭ হাজার ৩৫৯ টাকা ক্ষতি হয়েছে। গত ৯ জুলাই প্রকল্প পরিদর্শনের পর প্রণীত প্রতিবেদনের সুপারিশসমূহ অধিকাংশই বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে প্রকল্প পরিচালক জানালেও বাস্তবে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে ফলোআপও করা হয়নি।

নির্মাণকাজের গুণগতমান নিশ্চিত ও প্রকল্পের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে তদারকি করার জন্য প্রতি মাসেই-পিএমআইএসে হালনাগাদ তথ্য আপলোড নিশ্চিত করা, প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম তত্ত্বাবধান বাড়ানো এবং দুইটি অডিট আপত্তি নিষ্পত্তি করে অগ্রগতি ১০ নভেম্বরের মধ্যে আইএমইডি-কে অবহিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্ট অব বাংলাদেশ (আটাব) সিলেটের সাবেক সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে স্মারকলিপি দেন। সেখানে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনও অগ্রিম নেওয়া টাকা ব্যয়ের হিসাব দেয়নি।

প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে দুজন পরিচালককে নিয়োগ দিলেও বেবিচক কর্মকর্তাদের অসহযোগিতার কারণে তারা প্রকল্প থেকে সরে যেতে বাধ্য হন বলে স্মারকলিপিতে বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে নকশায় ত্রুটি রেখে প্রকল্পের কাজ শুরুর একমাত্র কারণ ছিল প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে অর্থ আত্মসাৎ। এর প্রমাণও মিলেছে। প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজ বাদ দিয়ে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই হাজার ১১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার প্রকল্পের ব্যয় এখন দুই হাজার ৯১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত সুবিধা পাইয়ে দিতে প্রকল্পের মূল নকশা থেকে তিনটি বোর্ডিং ব্রিজ, কার্গো বিল্ডিং অ্যান্ড পার্কিং এরিয়া, কার্গো অ্যানেক্স বিল্ডিং, ফায়ার ফাইটিং স্টেশন বাদ দেওয়া হয়েছে বলেও স্মারকলিপিতে অভিযোগ করা হয়। এসব অনিয়মের সুষ্ঠু তদন্ত করে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করে ওসমানী বিমানবন্দরে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসের ফ্লাইট চালুর ব্যবস্থা করার দাবি জানানো হয়।

আরবি/জেডআর

Link copied!