রাজধানীতে ২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হয় বঙ্গবন্ধু সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল। বিশ্বমানের সেবার প্রতিশ্রুতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও আদতে তা সীমাবদ্ধ থেকেছে কাগজ-কলমেই। নিয়োগে অনিয়ম ও বহুমুখী সংকটের ফেরে পড়েছে হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। তাই বিশ্বমানের সেবা দূরের কথা, নিম্নমানের কারণে এখন হাসপাতালে সেবা নিতে বিমুখ হচ্ছে রোগীরা।
হাসপাতালে সেবা নিতে আসা একাধিক রোগী রূপালী বাংলাদেশের কাছে হাসপাতালের চিকিৎসার মান, রোগী হয়রানিসহ নানা অব্যবস্থা নিয়ে অভিযোগ করেছেন। হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মো. রুহুল আমিন রূপালী বাংলাদেশের কাছে রোগী হয়রানির সত্যতা স্বীকার করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান।
নান্দনিক নির্মাণশৈলী আর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ১৫টি বিভাগ চালু রয়েছে। সকাল ও বিকেল দুই ধাপে নেওয়া যায় এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসাসেবা। প্রতিদিন গড়ে ১৬০ থেকে ২২০ জন রোগী সকালে ও বিকেলে হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা নেন। তবে, খুব কম ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে।
তথ্য মতে, বিশেষায়িত এ হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য চিকিৎসকসহ প্রায় ৬১০ স্বাস্থ্যকর্মীকে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তা সত্ত্বেও দু’বছর পেরিয়ে গেলেও আলোর মুখ দেখেনি হাসপাতালটির বেশিরভাগ সেবা কার্যক্রম।
এদিকে, লম্বা সময় ধরে পড়ে থেকে নষ্টের ঝুঁকিতে আইসিইউ, ল্যাব ও অপারেশন থিয়েটারসহ প্রায় ৫০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। সমস্যার সমাধান কবে হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৭৫০ শয্যার হাসপাতালটিতে বিশেষায়িত সেবার জন্য পৃথক পাঁচটি কেন্দ্র রয়েছে। যার মধ্যে ১০০ শয্যার আইসিইউ এবং জরুরি চিকিৎসার জন্য রয়েছে ১০০টি শয্যা। ৫০ শয্যার বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে ১৪টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার। ভিভিআইপি, ভিআইপি কেবিন, ডিল্যাক্স শয্যা রয়েছে ২৫টি।
এখানে এক্স-রে, এমআরআই, সিটি-স্ক্যানসহ অত্যাধুনিক সব ডায়াগনস্টিক সুবিধাও রাখা হয়েছে হাসপাতালটিতে। জরুরি বিভাগ, কার্ডিয়াক সেন্টার, লিভার ও কিডনি প্রতিস্থাপন ইউনিট এবং মা ও শিশু ইউনিট রয়েছে। রয়েছে সর্বাধুনিক রোবোটিক সার্জারি। তা সত্ত্বেও নেই রোগীর চাপ!
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল বিশ্বমানের সেবা প্রদানের কথা থাকলেও রয়েছে আস্থা সংকট। ৭৫০ শয্যার হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয় খুবই কম পরিমাণে। আইসিইউর জন্য ১০০ অত্যাধুনিক শয্যা থাকলেও দুই বছর ধরে ফাঁকা। অথচ অন্য হাসপাতালে সংকটাপূর্ণ রোগীর জন্য শত চেষ্টা করেও আইসিইউ শয্যা মেলানো যায় না। তবে, এখানে নামমাত্র প্যাথলজি ল্যাব চালু রয়েছে।
একইসঙ্গে, দিন দিন রোগীর সংখ্যা বাড়ার কথা থাকলেও হাসপাতালের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের সিন্ডিকেট, ভুল তথ্য প্রদানের মাধ্যমে রোগী ও তার স্বজনদের হয়রানি, সেবা প্রদানের অসহযোগী মনোভাবের ফলে মানসম্মত সেবার আস্থাহীন পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীর স্বজন মমতা নুর রূপালী বাংলাদেশকে জানান, রোগীকে নিয়ে উন্নত সেবা ও বন্ধুসুলভ ব্যবহার পাওয়ার আশায় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে আসি একজন অর্থোপেডিকস ডাক্তার দেখাতে। বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রোগী দেখার কথা থাকলেও প্রথমেই তথ্য ডেস্ক থেকে বিকেল ৪টায় জানানো হয়, অর্থোপেডিক্স ডাক্তার বের হয়ে গেছেন। এরপর ডেটা এন্ট্রির একজন জানান, ডাক্তার ভেতরে আছেন, আপনারা রোগীর টিকিট করুন।
তিনি জানান, রোগীর নাম এন্ট্রি করে কাউন্টারে টাকা জমা দিতে গেলে সেখান থেকে ডাক্তার নেই বলে জানানো হয়। বলা হয়, আজ আর রোগী দেখবেন না ডাক্তার। পরে ডেটা এন্ট্রির ওই ব্যক্তি আবার কাউন্টারে পাঠান ডাক্তার আছেন জানিয়ে। দ্বিতীয়বার সেখানে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে ডাক্তার দেখানো হয়।
ডাক্তার রোগী দেখার আগে তার প্রেশার ও ওয়েট মনিটরিং করে বিষয়টি বেশ ভালো উল্লেখ করে তিনি জানান, ডাক্তার তুলনামূলক কম সময় রোগী দেখেছেন। রোগীর সমস্যা, কেস হিস্টোরি পুরোপুরি না শুনেই ২ থেকে ৩ মিনিটের মধ্যে তাকে মেডিসিন লিখে দেন, সঙ্গে কিছু টেস্ট করাতে বলেন।
ডাক্তারের রুম থেকে আমাদের টেস্ট করানোর জন্য কাউন্টারে যেতে বলেন। আমরা কাউন্টারে গেলে আমাদের এক্স-রে রুমে ডেটা এন্ট্রির জন্য বলেন। সেখান থেকে প্রথমে টাকা জমার জন্য আবার কাউন্টারে পাঠান। এভাবে আমাদের তিনবার করে দুই জায়গায় ঘুরিয়ে হয়রানি করা হয়। পরে তাদের কাছে কেন এমন বারবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাঠানো হচ্ছে জানতে চাইলে দায়িত্বহীন আচরণ করেন বলে জানান রোগীর স্বজন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মানুষ হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসে সেবা পাওয়ার আশায়। অথচ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে যদি এভাবে পদে পদে হয়রানি করা হয়, তাহলে বিশ্বমানের সেবা পাওয়ার বিষয়টি কপটতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
একই ধরনের হয়রানির অভিযোগ করেন চিকিৎসা নিতে আসা আব্দুল মতিন (৩৮), নাছিমা বেগম, মাজেদুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন।
হাসপাতালে রোগী হয়রানিসহ সংকটের বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল) মো. রুহুল আমিন প্রথমেই রোগী হয়রানির বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জনবলের সংকট রয়েছে। যেখানে হাসপাতালটির কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করতে অন্তত ৩ হাজার জনবল প্রয়োজন, সেখানে রয়েছে মাত্র ২৮০ জনের কিছু বেশি। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি, যে লোকবল আমাদের রয়েছে, তা নিয়ে যতটা সেবা প্রদান করা যায় তা আমরা করছি। একই সঙ্গে আমাদের সব স্টাফ নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে যেসব সমস্যা ও অভিযোগ থাকে, তা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
প্রসঙ্গত, উদ্বোধনের পর বিএসএমএমইউর সাবেক উপাচার্য মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী হাসপাতাল পরিচালনা করা সম্ভব হলে এটি হবে দেশের সেরা সেবাকেন্দ্র। সেবা নেওয়ার জন্য করপোরেট হাসপাতালে বা বিদেশে যাওয়ার দরকার হবে না। একইসঙ্গে সম্পূর্ণ নিয়োগ শেষে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হলে রোগী ভর্তি ও উন্নত সেবা প্রদান করা হবে। স্পেশালাইজড হাসপাতাল নির্মাণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। যা হাসপাতাল চালুর ১৫ বছর পর পরিশোধ শুরু হবে।
আপনার মতামত লিখুন :