সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা গতকাল শুক্রবার ৯ দিন পার হলেও বিষয়টি নিয়ে জনমনে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে নানা প্রশ্ন। উল্টো তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটে আগুনের সূত্রপাত উল্লেখ করলেও বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে।
মূলত এই অগ্নিকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করেছেন, যার ফলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, আগুনটি নাশকতামূলক হতে পারে আর এর সূচনা হয় গানপাউডার দিয়ে। সিসিটিভি ফুটেজ ও অগ্নিকাণ্ডের ধরন থেকে তাদের মনে এমন সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে। তবে সরকারের তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে এটি বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে ঘটেছে বলে জানিয়েছে।
বৈদ্যুতিক ‘লুজ কানেকশনের’ (দুর্বল বিদ্যুৎ সংযোগ) কারণে আগুন লেগেছে বলে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ৩১ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে এক সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানানা তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি। নাসিমুল গণি দাবি করেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল ছিল, ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞ দল ছিল, সেনাবাহিনীর দল ছিল এবং পুলিশের সিআইডি থেকেও কাজ করা হয়েছে।
সবাই মিলে একত্রে একমত হয়েছি যে একটি “লুজ কানেকশনের” কারণে ইলেকট্রিসিটি থেকে আগুনের উৎপত্তি হয়েছে। এটা আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান। এতে কোনো ব্যক্তির সম্পৃক্ততা খুঁজে পাইনি।’
তবে তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদনের পরও এ ঘটনায় উঠে আসা কিছু প্রশ্ন জনমনে নানা ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। যেমন একটি কুকুরের মরদেহ উদ্ধার হওয়া এবং সাদা পাউডারের উপস্থিতি আগুনের উৎস নিয়ে ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছে।
সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের যে ফ্লোরে আগুন লেগেছে, ওই ফ্লোরের ছয়তলা থেকে একটি কুকুরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। বন্ধ সচিবালয়ের ছয়তলায় কুকুর কীভাবে গেল, সেটি একটি প্রশ্ন। তদন্ত কমিটির সদস্যরা ভিডিও ফুটেজ দেখে সে বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, কুকুরটি হেঁটে এসে একটি চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছে এবং আগুন লাগার একপর্যায়ে সে জেগে ওঠে, কিন্তু বের হতে পারেনি। কুকুরটি কীভাবে ঢুকল, সে সম্পর্কে কিছু পাওয়া যায় না ফুটেজে।
অন্যদিকে আগুন নেভার পর ভেতরে সাদা পাউডার-জাতীয় দ্রব্যের উপস্থিতি নিয়ে তখন প্রশ্ন উঠেছিল। এছাড়া ছুটির দিনে রাতের বেলায় আগুন লাগলেও তদন্ত কমিটি কীভাবে এসব বিষয়কে এড়িয়ে গেল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক তদন্তসংশ্লিষ্ট দুই বিশেষজ্ঞ জানান, সিসিটিভির ফুটেজ বিশ্লেষণে কোনো বাইরের আলামত না থাকা এবং পরীক্ষাগারে টেস্ট করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে এটা থেকে কোনো বিস্ফোরণ হয়নি।
এছাড়া এখানে নিয়ন্ত্রিত ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসেরও ব্যবহার হয়নি। তবে এমন ব্যাখ্যার পরও আগুনের উৎসে কুকুরটি কীভাবে গিয়েছিল এবং সেখানে সাদা পাউডারের উপস্থিতি কেন ছিল, সে বিষয়গুলো আরও তদন্তের প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এটা সেভাবে স্পষ্ট হয়নি যে, কীভাবে কুকুরটি ওই জায়গায় পৌঁছেছিল এবং সাদা পাউডারের উপস্থিতি কেন ছিল।
বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আগুনের ঘটনা একটি পরিকল্পিত নাশকতা হতে পারে, যেখানে গান (সাদা) পাউডারের ব্যবহার সন্দেহজনক। তারা বলেন, আগুন একাধিক জায়গায় একসাথে ছড়িয়েছে, যা সাধারণ অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে ঘটার কথা নয়। তাদের দাবি, উৎস থেকে বেশ দূরের রুমেও আগুনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, যা সাধারণত শর্ট সার্কিটের ফল নয়।
বিস্ফোরক বিশ্লেষক ও একাধিক অপরাধ বিশ্লেষকের দাবি, সিসি টিভির ফুটেজ ও আগুনের ছবি দেখে যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো নাশকতা। এসব বিষয়ে তদন্ত কমিটির আরও সময় নিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে পরামর্শ তাদের।
বুয়েটের এক বিস্ফোরক বিশ্লেষক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, আধুনিক গানপাউডার থেকে সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড, এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা। তাছাড়া সেখানে যেসব আলামত পাওয়া গেছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে এটাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই।
বুয়েটের কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ড. মো. ইয়াছির আরাফাত খান বলেছেন, আগুনের যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই ছবি অনেক পরের দিকে রেকর্ড করা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘স্যাবোটাজ সামনে রেখে এটা বলা হচ্ছিল যে বিভিন্ন জায়গা থেকে তো একসঙ্গে ফায়ার হতে পারে না। শুরু থেকেই আমরা এটা নিয়ে কাজ করছিলাম। আমরা যখন আগুনের সূত্রপাত থেকে কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এটা অনুসন্ধান করছিলাম, তখন মিডিয়া যেগুলোর কথা বলছে শুরুতে, এসব জায়গায় আগুন ছিল না। আধাঘণ্টা পরের সিনারি ছিল এটি। তখন পুরো করিডর পুড়তেছে, কিছু কিছু রুমে আগুন ঢুকে পড়ছে। যে রুমে আগুন ঢুকছে, সেই রুমের জানালা দিয়েও দেখা গেছে আগুন। শুধু ওই ছবিটা দেখলে যে কারো মনে হবে এটা নাশকতা।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নয়তলা ভবনের সাততলা, ছয়তলা এবং আটতলায় পৃথক তিন স্থানে একই সময়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা গেছে। শর্ট সার্কিটের ঘটনা ঘটলে সেই আগুন একই ফ্লোরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়বে। আগুন এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে একই সময়ে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই। কাজেই এটা নাশকতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।
গোয়েন্দারা দাবি করেন, নাশকতা মনে হওয়ার কারণ, সচিবালয়ের ভবনগুলোতে প্রতিটি ফ্লোরে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পৃথকভাবে সার্কিট ব্রেকার বসানো আছে। ইচ্ছা করলে যে কেউ একটা ফ্লোরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ও চালু করতে পারবে। শর্ট সার্কিট হলে নির্দিষ্ট ওই ফ্লোরেই আগুন একই সময় ছড়িয়ে পড়বে। অন্য ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ নেই। এছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং আলামত আছে, যা থেকে মনে করা যায় যে, এটি একটি পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড।
এ বিষয়ে সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এটি নাশকতা ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কারণ ঘটনাস্থল থেকে গানপাউডারের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। এরই মধ্যে এসব আলামত পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব পরীক্ষায় স্বাভাবিক অগ্নিকাণ্ড মনে হয়নি। এ জন্য তদন্ত আরও সময় নিয়ে করে সঠিক তথ্য-প্রমাণ সামনে আনতে হবে বলে মন্তব্য করেন এই কর্মকর্তা।
নতুন তদন্তের দাবি: প্রথম দিকে উপদেষ্টারা ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্য করলেও পরে তারা বিষয়টি অন্যদিকে নেওয়া চেষ্টা করেন। তবে, বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গানপাউডার ব্যবহার হয়েছে কি না, সেটা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখতে পরামর্শ থাকবে। সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন লাগার পর ২৬ ডিসেম্বর পরিবেশ ও পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, গানপাউডার ব্যবহার হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।
দেশের সচেতন মহল বলছে, সচিবালয়ের আগুন নিয়ে যে প্রশ্ন সবাই তুলেছেন, সেটি হলো ভবনের দুই দিকে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে আগুন কেন। আগুন লাগার পর যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, সেখানে সচিবালয়ের সামনে থেকে ৭ নম্বর ভবনটির দক্ষিণ দিক দেখা যায়। সেখান থেকে ভবনের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে আগুন জ্বলতে দেখা যায়। ভিন্ন ভিন্ন রূপে আগুনের কারণ এবং যথাযথ তথ্য-প্রমাণ দিতে পারেনি তদন্ত কমিটি। তারা আরও বলছেন, তদন্ত কমিটি এর আগে বলল, দেশের বাইরে পরীক্ষার জন্য আগুনের স্যাম্পল পাঠানো হবে। এর পরই আবার ঘটনাটিকে লুজ কালেকশন হিসেবে চালিয়ে দিল। দেশের মানুষ জানতে চায়, সচিবালয়ে যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেটা আসলেই কী ছিল?
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গাজী জহিরুল ইসলামের দাবি, সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আর পাল্টাপাল্টি দোষারোপের কারণে তদন্ত রিপোর্টে কী উঠে আসে তা নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল অনেকের। দুই দিকের আলাদা কক্ষে আগুন লাগা, কুকুরের মৃতদেহ, অগ্নি নির্বাপণে বিলম্বের কারণ এবং সাদা পাউডারের উপস্থিতির মতো বিষয় সামনে এনে জনমনে সন্দেহ এবং জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। এসব প্রশ্ন সামনে রেখেই সচিবালয়ের আগুন নাশকতামূলক কি না, সেই প্রশ্ন থেকে যায়। এ বিষয়ে নতুন করে তদন্তের দাবি জানান তিনি।
এদিকে আগুনের ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ এবং সচিবালয়ের দুর্নীতির তথ্য নিশ্চিহ্ন করতে সচিবালয়ে আগুন দেওয়ার মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করা হয়েছে বলে দাবি করে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছিলেন, ‘স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের বিগত সময়ে হওয়া অর্থ লোপাট, দুর্নীতি নিয়ে আমরা কাজ করছিলাম। কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের প্রমাণও পাওয়া গিয়েছিল। আগুনে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এখনো জানা যায়নি। আমাদের ব্যর্থ করার এই ষড়যন্ত্রে যে বা যারাই জড়িত থাকবে, তাদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।’
এ ঘটনা নিয়ে আমলাদের সমালোচনা করে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিজমের এনাবলারদের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারের উদারতা দেখানোর পরিণাম এই কপালপোড়া জাতিকে অনন্তকাল ভোগাবে। হাসিনার ঘি খাওয়া ফ্যাসিস্ট এনাবলররাই এখন মানবাধিকারের আলাপ দিয়ে ফ্যাসিস্টদের পক্ষে ‘সিমপ্যাথি গেইন’ ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। এই ক্যাম্পেইন না থামাতে পারলে আপনি শেষ। আজকে আমলা, আগামীকাল অন্য কেউ।’
সচিবালয়ে আগুনের ঘটনাকে ষড়যন্ত্রমূলক নাশকতা বলে দাবি করে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘সচিবালয়ের আগুন শুধু আমাদের দুই সহযোদ্ধা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামের রুমে লাগানো হয়েছে। সেখানে কুকুরের মরদেহই প্রমাণ করে এটি ষড়যন্ত্র।’
পরবর্তী সময়ে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ‘লুজ কানেকশন’ বিষয়টি উঠে আসায় সচিবালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রথমে আগুনের ঘটনায় উপদেষ্টাদের ভিন্ন ভিন্ন মন্তব্যের কারণেই জনমনে বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়, যা সরকারকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
এসব প্রশ্ন ও সন্দেহের যৌক্তিক মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত জনমনে বিভ্রান্তি থেকেই যাবে। এর ফলে সরকারের নীতি ও কার্যক্রমের প্রতি চরম আস্থার সংকট সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আপনার মতামত লিখুন :