ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

যৌক্তিক-অযৌক্তিক আন্দোলন চরম ভোগান্তিতে নগরবাসী

মেহ্দী আজাদ মাসুম

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৪, ০৫:০৮ পিএম

যৌক্তিক-অযৌক্তিক আন্দোলন চরম ভোগান্তিতে নগরবাসী

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

মানুষের কাছে আর একটু সময় চাই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
অযৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নামা ঠিক নয় : ড. বদিউল আলম মজুমদার


বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকারের পথ চলার শুরু থেকেই দেশের নানা পেশার মানুষেরা যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি নিয়ে মাঠে নামছেন, বন্ধ করে দিচ্ছেন সড়কে চলাচল। কোনো ঘোষণা ছাড়াই সড়কে নেমে দাবি আদায়ে এমন আন্দোলনে প্রতিদিন রাজধানীসহ আশপাশের জেলার মানুষকে পড়তে হচ্ছে চরম ভোগান্তিতে।

এ নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই বলে মনে হচ্ছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আমরা দেশের মানুষের কাছে আর একটু সময় চাই। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীসহ দেশের মানুষ প্রায় দেড় দশক ধরে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েও কথা বলতে পারেনি। এখন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ পেয়ে তাদের দাবি জানাচ্ছেন। তবে শিগগিরই এসবের সমাধান হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

বিষয়টি সম্পর্কে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিদায়ী রাজনৈতিক সরকারের সময়ে দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। এই সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক, দাবি অনেক। তবে অযৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো কারও কাছেই কাম্য নয়। এমনটার ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে সরকারকে।

গত বুধবারও গাজীপুর-আশুলিয়াসহ অনেক জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ ছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনে শতাধিক শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর এক দিন আগে গত মঙ্গলবার ক্যাম্পাসের নাম পরিবর্তনসহ ১৫ দাবিতে নরসিংদী সদর উপজেলার সাহে প্রতাব এলাকায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন নরসিংদী তাঁত বোর্ড শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের বিএসসির শিক্ষার্থীরা। দুপুর ২টা থেকে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যা ৬টায় এ প্রতিবেদন তৈরি পর্যন্ত অবরোধ চলছিল এবং এতে মহাসড়কে প্রায় চার কিলোমিটার যানজট তৈরি হয়। শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ, সেমিস্টার ফি মওকুফ, তাঁত বোর্ড শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্তর্ভুক্তকরণ, প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন। এর এক দিন আগে ৯ সেপ্টেম্বর উপসহকারী প্রকৌশলী পদ শুধু ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য নির্দিষ্ট করাসহ কয়েকটি দাবিতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টানা ছয় ঘণ্টা রাজধানীর তেজগাঁওর গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি অবরোধ করে রাখেন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন কারিগরি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সাতরাস্তা এলাকায় তাঁদের এ অবরোধে যান চলাচল বন্ধ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। কোথাও কোথাও পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় অনেককে রাস্তায় এক জায়গায় আটকে থাকতে হয়।

সাভারের আশুলিয়া শ্রমিক আন্দোলনে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অশান্ত শিল্প এলাকা। গত মঙ্গলবার অধিকাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিলেও দুপুরের পর অনেক কারখানায় অসন্তোষ দেখা দেয়। ৩২টি কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে ভেতরে বসে থাকেন। একপর্যায়ে কর্তৃপক্ষ ছুটি ঘোষণা করলে তারা বেরিয়ে যান। কারখানা মালিকরা জানান, এরই মধ্যে শ্রমিকদের বেশকিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। একই দিনে আশুলিয়ায় ৪২টি কারখানা বন্ধ ছিল। এ ছাড়া গাজীপুরের ২৫টি কারখানায় কাজ হয়নি শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে। এসব ঘটনার এক সপ্তাহ আগে, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয় ঘেরাও করে দেশের সব প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের স্বীকৃতি এবং এমপিওভুক্তিসহ চার দফা দাবিতে বিক্ষোভ করে। সচিবালয়ের প্রতিটি প্রবেশ পথে তাদের অবস্থানের কারণে বিকেল ৩টার দিকে সচিবালয়ের ভেতরে আটকা পড়েন অনেকেই। ৪টার দিকে সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে স্বাভাবিক হয় প্রবেশপথগুলো।

একই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী দিনভর সচিবালয় ঘেরাও করে রাখার পর জোর করে ভেতরে প্রবেশ করে। রাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর তারা চলে যায়। সপ্তাহ দুয়েক আগে শুধু প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয় নয়, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে জড়ো হওয়া শুরু হয়েছিল। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিতসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সড়কে আসতে দেখা যায়। সরকার পতনের পর থেকেই নানা বৈষম্য ও হয়রানির শিকার হয়েছেন জানিয়ে তারা ঢাকায় এসে আন্দোলনে নামছিলেন।

এসব দাবি আদায়ে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন অন্তত বিশটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর আগেও সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বঞ্চিত এবং পুলিশের বঞ্চিতরা আন্দোলন করে দাবি আদায় করেছেন। চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সচিবালয়ে শিক্ষা সচিবকে ঘেরাও করে স্থগিত এইচএসসি পরীক্ষা বাতিলের দাবি আদায় করে। দাবি আদায়ে পেশাজীবীদের মধ্যে একধরনের উৎসাহও বেড়েছে, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে বাড়ছে অস্বস্তি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের অনেকেই দাবি আদায়ের এই তোড়জোড়কে ভালোভাবে দেখছেন না।

এদিকে সচিবালয়েও ডিসি পদে পদায়ন নিয়ে চলছে চরম অসন্তোষ। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বদলে সৃষ্টি হয়েছে অস্থিরতা। উত্তেজনা যেন থামছেই না। গত মঙ্গলবারের হট্টগোল ও হাতাহাতির ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদকে দিয়ে গঠিত হয়েছে এক সদস্যের তদন্ত কমিটি। আর সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে জেলা প্রশাসক পদে যোগদানে বারণ করা হয়েছে পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের। গত বুধবারও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে নিয়োগবঞ্চিতদের অসন্তোষ ও হট্টগোল করতে দেখা যায়। এই দিন দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজের মাধ্যমে ডিসি পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক যুগ্ম সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আমাদের মেসেজটি পাওয়া মাত্র সেটা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে কর্মকর্তাদের।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী দৈনিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীসহ দেশের মানুষ প্রায় দেড় দশক ধরে নানা সমস্যার মুখোমুখি হয়েও কথা বলতে পারেনি। এখন সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ পেয়ে তাদের দাবি জানাচ্ছেন। তবে শিগগিরই এসবের সমাধান হয়ে যাবে। আমাদের আর একটু সময় দিতেই হবে।’

আরবি/জেডআর

Link copied!