কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না সরকারি গাড়ির অপব্যবহার ও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়। এসব গাড়ির জ্বালানির পেছনে বছরে খরচ দেড়শ কোটি টাকা। নতুন গাড়ি কিনতে কর্মকর্তারা ৩০ লাখ টাকার ঋণসুবিধা ও জ্বালানি খরচ নেন। তার পরও অনেকেই দপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করেন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও ৪০০ গাড়ি জমা দেননি কর্মকর্তারা। ফলে বাড়ছে সরকারি খরচ। ১৫ বছরে মন্ত্রী-এমপিদের পাশাপাশি আমলারাও গাড়ি ব্যবহারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছেন। সরকারি আমলাদের গাড়িবিলাস গত ১০ বছরে প্রকট হয়েছে। পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখা কিংবা তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ প্রসস্থ করার দোহাই দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও আমলারা নিয়েছেন সরকারি যত সুবিধা। নিজের পাশাপাশি স্ত্রী-সন্তানদের জন্য আলাদা গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে অনেক আমলার বিরুদ্ধে।
সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা পর্যন্ত সরকারি গাড়ির সুবিধা পান, বর্তমানে যে সংখ্যা আড়াই হাজার। এসব গাড়ির পেছনে প্রতি বছর শুধু জ্বালানি খরচ হয় দেড় শ কোটি টাকা। পাশাপাশি আছে চালকের বেতন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ। আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেন রাম রাজত্ব পেয়ে বসেছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারি টাকায় গাড়ি কেনা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলেও থেমে থাকেনি কেনাকাটা। ডিসি, ইউএনওদের জন্য ২০০ নতুন গাড়ি কেনার খবর প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে, যেখানে প্রতিটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছিল ১ দশমিক ৬৯ কোটি টাকারও বেশি। অর্থনৈতিক সংকটের সময় সরকার যখন কৃচ্ছ্রসাধনে গুরুত্ব দিচ্ছে, তখন জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) জন্য ২০০ মিৎসুবিসি, পাজেরো কিউএক্স জিপ গাড়ি কিনতে তোপের মুখে পড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ‘পরিবহন সরঞ্জাম’ খাতে ৬ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়।
তবে ফ্যাসিবাদ পতনের পর সরকারি কাজে বরাদ্দকৃত গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়মের বাইরে গিয়ে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সব মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে এমন একটি চিঠিও পাঠানো হয় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বিধিবহির্ভূত সরকারি গাড়ি ব্যবহার করায় এ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে সরকার অনমনীয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের কিছু কর্মচারীর প্রাধিকারবহির্ভূত গাড়ি ব্যবহারের এরূপ প্রবণতার ফলে একদিকে যেমন জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ও আর্থিক অপচয়ের কারণ ঘটছে, তেমনি অন্যদিকে নৈতিকতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে সমাজে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সরকারের দায়িত্ব ও সচেতনতা সম্পর্কেও জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ ধারণা তৈরি হচ্ছে। সরকার এ ধরনের বিষয়ে অনমনীয় নীতি গ্রহণ করেছে।
আওয়ামী লীগ আমলে কর্মকর্তাদের নতুন গাড়ি কিনতে বিনা সুদে ৩০ লাখ টাকা ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। জ্বালানি খরচ হিসেবে প্রতি মাসে দেওয়া হয় আরও ৫০ হাজার টাকা। সরকারি সুবিধায় নতুন গাড়ি কিনে অনেকেই দপ্তরের গাড়ি ছাড়েন না। বাসায় গাড়ি রেখে রুটের গাড়িতে চড়েন, ব্যবহার করেন প্রকল্পের যানবাহান। পরিচয় গোপন রেখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, অনেকই এই সুবিধা নেন। এটা নতুন কিছু না। গাড়ি কেনার সুবিধা নিয়ে অনেক কর্মকর্তাই দপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করেন। তারা ভাড়াও পরিশোধ করেন না। প্রকল্পের গাড়ির যথেচ্ছ ব্যবহারও আছে। ফলে সরকারি ব্যয় বাড়ছে। দেখার যেন নেই কেউ।
অনেক কর্মকর্তাই স্ত্রী-সন্তানদের ব্যক্তিগত কাজে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা মার্কেটের সামনে হরমহামেশা দেখা যায় এসব গাড়ি। কারওয়ান বাজারে সকালে বাজার করতে গেছেন বাসার কর্মচারী। ড্রাইভার ভেতরে এসি চালু রেখে গুমাচ্ছেন। এমন অনেক সরকারি গাড়ির দেখা মিলবে কারওয়ান বাজারে। এবং প্রতিদিন সকালে একই চিত্রের দেখা মিলে এখানে। এ ছাড়া ভিকারুননিছা নুন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল ও বনশ্রী আইডিয়াল কিংবা ভালো মানের যে কোনো স্কুলের সামনে দেখা মিলবে সরকারি গাড়িতে করে সন্তানকে স্কুলে দিয়ে এবং নিয়ে আসার চিত্র।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের ট্রান্সপোর্ট কমিশনার ও অতিরিক্ত সচিব এম এ এইচ হুমায়ুন কবীর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মতো সরকারি কর্মকর্তারাও নিয়মবিহর্ভূতভাবে দপ্তরের গাড়ি ব্যবহার করেছেন, যা এখনো বহাল আছে। প্রকল্প শেষের ৬০ দিনের মধ্যে পরিবহন পুলে গাড়ি জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও এখনো জমা পড়েনি ৪০০ গাড়ি। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এ ব্যাপারে আদেশ জারি করেও ফল পাওয়া যায়নি। সরকারি গাড়ি জমা নেওয়ার কোনো কৌশল কাজ করছে না। কেউ যদি নিজ থেকে জমা না দিয়ে যান, তবে জোড় করে আনার কোনো বিধান নেই। সেই সুযোগই কাজে লাগাচ্ছেন তারা। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কিছু গাড়ি হয়তো পড়ে আছে, জমা দেওয়ার পরিস্থিতিতে নেই হয়তো তারা। তবে মোদ্দা কথা হলো, ‘সরকারি মাল দরিয়া মে ঢাল’ পুরোনো সেই প্রবাদ তো সবারই জানা।
ট্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমলারা শুধু ক্ষমতার অপব্যবহারই করেন না, তারা সরকারি অর্থের অপচয়ও করেন। দুর্নীতিতে মোড়ানো তাদের আপাদমস্তক। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা খুবই জরুরি। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে এসব দুর্নীতিবাজ বের হয়ে যায়। তাদের জন্য আইনের সঠিক প্রয়োগ জরুরি। দুর্নীতির লাগাম না টানতে পারলে দেশের উন্নয়নে ভাটা পড়বে এটাই স্বাভাবিক। জনগণের করের টাকায় সরকারি যানবাহনের যথেচ্ছ ব্যবহার ও অর্থের অপব্যায়ে এখনই লাগাম টানার দাবি জানান তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :