চার মেয়াদে ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে এমপি ছিলেন। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাবেক এমপি সাদেক খান রাজনৈতিক জীবনে দখল, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে ছাত্র-জনতা হত্যাযজ্ঞে ছিলেন অন্যতম কুশীলব। তার নির্দেশে মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকায় আন্দোলন দমাতে হত্যাযজ্ঞ চালাতে রাজপথে থেকে অস্ত্রধারীদের দিকনির্দেশনা দেন।
বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িতে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি সাবেক সংসদ সদস্য সাদেক খান গ্রেপ্তার হয়ে বর্তমানে কারাগারে বন্দি। তবুও থেমে নেই সাদেক খানের অনুসারীদের দখল চাঁদাবাজি। কারাগারের ভেতরে থেকে পলাতক ছেলে ফাহিমকে দিয়ে ‘সাদেক বাহিনী’র সন্ত্রাসীদের দিয়ে চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছেন। গত দেড় দশক বৃহত্তর মোহাম্মদপুর-ধানমন্ডি এলাকার দখল, চাঁদাবাজি ও অস্ত্রধারীদের মহড়া চলেছে সাদেক খানের ইশারায়। এলাকায় তার পরিচিতি দখলবাজ হিসেবে। তবে বর্তমানে চাঁদাবাজি চলে নতুন মুখ দিয়ে। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দোসর সাদেক খান ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। সাদেকের দখলবাজির নেশায় কবরস্থান-শ্মশানও বাদ যায়নি। এলাকায় ‘সাদেক বাহিনী’ ও কিশোর গ্যাংয়ের গডফাদার ছিলেন।
সাদেক খানের দখল সাম্রাজ্যের ভাড়া ও চাঁদাবাজির টাকা ওঠানোর কাজ করতেন তার ছেলে ফাহিম খান। ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে সাদেক খান ছেলেকে বানান দলের মোহাম্মদপুর থানা কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি। বাবা ও নিজের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ফাহিম খান নিজেও দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে কম যাননি। সাদেক বাহিনী ও সাদেক খানের পরিবারের চাঁদা আদায়ের জন্য ১০-১২ জন নিয়োগকৃত ম্যানেজার রয়েছেন। প্রধান ম্যানেজার জুলহাস বেপারি ও জাকিরের নেতৃত্বে ম্যানেজাররা একেক সাইড থেকে দৈনিক টাকা কালেকশন করে বুঝিয়ে দিতেন সাদেক খানের একসময়ের ড্রাইভার সুমনের হাতে। এই সুমনই প্রতিরাতে চাঁদার টাকা পৌঁছে দিতেন এমপিপুত্র ফাহিমের কাছে। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আত্মগোপনে রয়েছেন ফাহিমসহ সাদেক খানের প্রায় সব সহচর বা সাদেক বাহিনীর শীর্ষ অস্ত্রধারী। তবে নতুন নতুন মুখ দিয়ে চাঁদা আদায় অব্যাহত রয়েছে বলে সরেজমিনে সত্যতা মিলেছে।
২০১৮ সালে আ.লীগের ডাকসাইটে নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানককে পেছনে ফেলে সাদেক খানের দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্তির বিষয়টি তাদের জন্য ছিল বিস্ময়কর। তেমনি পরের পাঁচ বছর এমপি থাকা অবস্থায় গোটা নির্বাচনী এলাকায় তার দখল সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়টিতেও আলোচিত সব মহলে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও সংলগ্ন এলাকায় দখলবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক কারবারসহ বহু অভিযোগ ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক এমপি সাদেক খানের বিরুদ্ধে। সরকারি জমি, হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি, অন্যের জায়গা দখল করেছেন দেদার। বাদ যায়নি কবরস্থান, শ্মশানও। দখল করা জায়গায় নিজের নামে করেছেন আবাসন প্রকল্প, পেট্রল পাম্প, মার্কেট কিংবা বস্তি। দখল করা জমিতে ভবন ও মার্কেট-দোকান বানিয়ে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকা ভাড়া আদায় করেন সাদেক সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
সাদেক খানের নির্বাচনি এলাকায় একসময় হিন্দুদের প্রচুর জমিজমা ও সম্পদ ছিল। কিন্তু সাদেক খান ও তার পরিবারের দখলবাজির কারণে অনেককেই সব হারিয়ে এলাকা ছাড়তে হয়েছে। এ ছাড়াও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক রাস্তার নামকরণও করেছেন সাদেক খান। রায়েরবাজার মসজিদের পেছন থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাস্তাটিকে ‘সাদেক খান রোড’ নামকরণ করেছেন তিনি। এ ছাড়া রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধসংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন রাস্তা পরিবারের সদস্যদের নামে মিয়া চান খান সড়ক, আজিজ খান সড়ক, মুকিম খান রোড এবং হাসেম খান রোড নামকরণ করেছেন।
সাদেক খান, তার পরিবার ও সাদেক বাহিনীর সদস্যরা মিলে এখনো অবৈধভাবে স্থাপিত মার্কেট ও আবাসন থেকে প্রতি মাসে ২ কোটি টাকার ওপর ভাড়া পান। বাজারের মার্কেট ও আড়তের প্রায় ৭০০টি দোকান ভাড়া বাবদ বছরে তোলেন প্রায় ১১ কোটি টাকা। কেরানীগঞ্জ, সাভার ও বছিলা থেকে এই বাজারে আসা মাছ, ফল ও কৃষিপণ্যবাহী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি বাবদ আসত কয়েক কোটি টাকা। সাদেক খান বস্তির ঘর ভাড়া বাবদ আসে কোটি টাকার ওপরে। মোহাম্মদপুর মোড়ের ছোট-বড় প্রায় ২০টি নার্সারি এবং সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার ফল, ফার্নিচার, বাঁশ ও ইট কেনাবেচার দোকান আর বেশ কয়েকটি ট্রাক ও পিকআপ স্ট্যান্ড থেকেও নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন সাদেক বাহিনীর সদস্যরা। এভাবে অবৈধ স্থাপনার ভাড়া ও চাঁদাবাজি আদায় থেকেই বছরে প্রায় ২৫ কোটি টাকা আয় হয় সাদেক খানের।
বর্তমানে প্রতিপক্ষদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দখল ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছেন সাদেক বাহিনীর সদস্যরা। মোহাম্মদপুর এলাকার অধিকাংশ কিশোর গ্যাংয়ের সৃষ্টি ‘সাদেক খান বস্তি’ থেকে। এদের দিয়ে এলাকায় দখলদারি, চাঁদাবাজি ও মাদকের কারবার করাতেন সাদেক। কেউ তার মতের বাইরে গেলে ক্যাডার বাহিনীর পাশাপাশি কিশোর গ্যাং দিয়ে শায়েস্তা করতেন।
স্থানীয়দের তথ্যমতে সাদেক খান বংশগতভাবেই ‘দখলবাজ’। এমপি হওয়ার আগে চার মেয়াদে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন সাদেক খান। তখনই তার দখলবাজির হাতেখড়ি। ২০১৮ সালে এমপি হওয়ার পর থেকে তার সস্ত্রাসী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়।
আশি ও নব্বইয়ের দশকে পরিবারের উত্তরাধিকার হিসেবে সাদেক খান, তার ভাইরাসহ পরিবারের অন্যদের মাধ্যমে দখলবাজি চলে। পর্যায়ক্রমে সাদেক খানের ছেলে ফাহিম খানসহ পরবর্তী প্রজন্মও তাদের সহযোগী হয়। আশি ও নব্বই দশকেও বর্তমান মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ ও সংলগ্ন এলাকায় অনেক খালবিলের অস্তিত্ব ছিল। পরে সেসব খাল ভরাট করে ঢাকা উদ্যান, আবাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অনেক স্থাপনা গড়ে ওঠে। একইভাবে মোহাম্মদপুরের বছিলা, ৪০ ফিট এবং তিন রাস্তার মোড় থেকে আঁটিবাজার পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশ দিয়েও বহমান সরকারি খাল ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি দখল করে গড়ে তোলা হয় আবাসন প্রকল্প। এসবের নেপথ্যে কাজ করেছেন সাদেক খান। কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় খাল ভরাট করে বসতি গড়ায় সহযোগিতা করার বিনিময়ে প্রতিটি আবাসন কোম্পানির কাছ থেকে মাসোহারা হিসেবে ‘প্রটেকশন মানি’ নিয়েছেন তিনি। একইভাবে প্রভাব খাটিয়ে মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান, বছিলা, কাটাসুর ও জাফরাবাদ এলাকার অনেকের জমি ও বাড়িঘর দখল করেছেন সাবেক এই এমপি।
সাদেক খান ১৯৭৩ সালে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সদস্য পদের মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এরপর ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের তৎকালীন ৪৭নং ওয়ার্ড ও বর্তমান ৩৪নং ওয়ার্ড থেকে পরপর চার বার কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। দুইবার ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। ১৯৯৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সে সময় থেকেই নিজের দলের মধ্যেই একাধিক গ্রুপিং সৃষ্টি করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে রাতের ভোটে হন ঢাকা-১৩ আসনের এমপি। এরপর আর পেছনে তাকানো লাগেনি তার।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, শিয়া মসজিদ, আদাবর, বসিলা, ঢাকা উদ্যান, বুদ্ধিজীবী, জাফরাবাদ, পুলপাড়, গদিঘর, রায়েরবাজার নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩ আসন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪নং ওয়ার্ড পুরোটাই এই আসনের অন্তর্গত। রাজধানীর এই বিশাল এলাকার বেশির ভাগেরই নিয়ন্ত্রণ সাদেক খানের হাতে।
মোহাম্মদপুর, কাটাশুর, জাফরাবাদ, বুদ্ধিজীবী, রায়েরবাজার, গদিঘর, বসিলা, ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিলেন তিনিই সর্বেসর্বা।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্য অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। সাদেক খানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ভূমি দস্যুতাসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকরি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। তার দেশ-বিদেশে বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট এবং নিজ নামে পেট্রল পাম্প, বস্তি, মার্কেট, কাঁচামালের আড়তসহ অঢেল সম্পদের খোঁজ মিলেছে। এ ছাড়াও বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড় কেরানীগঞ্জেও সাদেক খানের ইটভাটা, বালুমহাল, আবাসন ব্যবসাসহ অনেক সম্পদ রয়েছে। এমপি থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালে মালয়েশিয়ায় বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন। এ ছাড়া স্ত্রীসহ পরিবারের সদস্যদের নামেও দেশ-বিদেশে অঢেল সম্পদ রয়েছে তার।
এদিকে, গত ২১ অক্টোবর দুদকের আবেদনের পর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত সাদেক খান ও তার স্ত্রী ফেরদৌসী খানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়। গত ২৪ আগস্ট রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সাদেক খান। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা মামলা, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিহত ট্রাকচালক মো. সুজনসহ (২৪) তিনটি হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছেন তিনি।
আপনার মতামত লিখুন :