ঢাকা রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪

নিরাপত্তার আগ্নেয়াস্ত্র জীবনহানির শংকায়

মেহ্দী আজাদ মাসুম

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪, ১১:৪২ পিএম

নিরাপত্তার আগ্নেয়াস্ত্র জীবনহানির শংকায়

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

’৯০-এর গণআন্দোলনে স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর বিএনপি ও তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ৩০ বছরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং জেলা প্রশাসন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও ছাত্রনেতাদের নিরাপত্তায় অর্ধলক্ষাধিক আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিয়েছিল। তবে পরবর্তীতে পাঁচ বছর পরপর ক্ষমতায় আসা সরকারের দায়িত্বশীলরা পর্যায়ক্রমে এর অন্তত ৮০ শতাংশ অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়। এমন রেওয়াজে বিগত ৩০ বছরে সারা দেশে বাতিল হওয়া এসব অস্ত্রের সিংহভাগই উদ্ধার হয়নি।

জীবন রক্ষায় দেওয়া সেসব অস্ত্র এখন জীবনের জন্য মারাত্মক হমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদিকে তিন দশকে বৈধ থেকে অবৈধ হওয়া অস্ত্র ও অস্ত্রের লাইসেন্সের কোনো তথ্যই নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। যদিও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বলেছেন, বৈধ থেকে অবৈধ হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে শিগগিরই বড় ধরনের অভিযান শুরু করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বৈধ থেকে অবৈধ হওয়া অস্ত্র উদ্ধার যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা। আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পরবর্তী সভায় বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে জানান তিনি।

বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল (উপসচিব) এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘৩০ বছরে দেওয়া প্রকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স কত, লাইসেন্সের মালিক কারা ছিলেন ও জমা না দেওয়ায় অবৈধ হয়ে যাওয়া অস্ত্রের সংখ্যা কত, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই মন্ত্রণালয়ের কাছে। নেই কোনো ডেটাবেজও! ওয়েভ সাইটেও অস্ত্রের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্নের উদ্রেক করেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কার্যক্রম কি লোক দেখানো ছিল! পুলিশের শীর্ষ পদের সাবেক একাধিক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, অস্ত্র জমা না দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল। কেন বিগত সময়ে করা হয়নি, তা খতিয়ে দেখে যারা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে সাবেক সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ২১ হাজার আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। সারা দেশের সুপারিশ পাওয়া এই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে ছিলেন রাজনীতিক, শিল্পপতি, সরকারি কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও ছাত্রনেতা। কয়েকজন সন্ত্রাসীও এই সুযোগ বাগিয়ে নিয়েছেন অস্ত্রের লাইসেন্স। তবে এর মধ্যে কত ব্যক্তি আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয় করেছেন, তাদের পরিচয়ইবা কী, তার কোনো তথ্য নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে!

নেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সুপারিশ করা ফাইলও। অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগস্টের পর পলাতক সাবেক মন্ত্রীর পিএস হারুনুর রশিদ বিশ্বাস, এপিএস মনিরুল ইসলাম ও পিআরও শরীফ মাহামুদ অপু গুরুত্বপূর্ণ অনেক ফাইল ও কাগজপত্র সরিয়ে নিয়ে গেছেন। এর আগেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে বলে জানায় তথ্য দেওয়া সূত্রটি। অনুসন্ধানে জানা যায়, ’৯০-এর গণআন্দোলনের পর ’৯১, ’৯৬ ও ২০০১-এর সরকারের ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই ঘটনা। স্বাভাবিক কারণেই গত ৩০ বছরে সারা দেশে কত আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হয়েছে, পরবর্তীতে কত বাতিল করা হয়েছে, বাতিল হওয়া অস্ত্রের মধ্যে কতটি অস্ত্র জমা দেওয়া হয়েছে, তার কোনো পরিসংখ্যানই নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।

যদিও সম্প্রতি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের দেওয়া ৭৭৮টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এসব অস্ত্রের মালিকরা নির্ধারিত সময়ে তাদের লাইসেন্স জমা না দেওয়ায় বাতিল করা হয় লাইসেন্স। বৈধ থেকে অবৈধ হয়ে যাওয়া ৭৭৮ অস্ত্রের মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশনা থাকলেও গত এক মাসেও আইনগত কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি এই অস্ত্র উদ্ধারেও কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ’৯১-এ প্রথম অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিএনপি সরকার গঠন করে। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় ’৯৬-এ সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

নতুন এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএনপি সরকারের দেওয়া (’৯১-’৯৬) ১,৬১৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের মধ্যে ১,১৮৭টির লাইসেন্স বাতিল করে। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া (’৯৬-২০০১) ৩,৮৪৬টির মধ্যে ৩,১৪১টির লাইসেন্স বাতিল করে।

ওয়ান ইলেভেনের সময় বিএনপির দেওয়া (২০০১-২০০৫) ৩,৪২৩টি অস্ত্রের সবই বাতিল করে দেওয়া হয়। এরপর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) সব রেকর্ড ভঙ্গ করে ৩১,৪৭৯টি অস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান করা হয়। এই সরকারের সর্বশেষ সময়ে (২০১৮-২৪) দেওয়া ২,১১৮টি অস্ত্রের লাইসেন্সের মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ৭৭৮টি লাইসেন্স বাতিল করে।

১৫ বছরে কত লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে জানে না পুলিশ সরকার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে যৌথ অভিযান শুরুর প্রায় দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের মেয়াদে ইস্যুকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের প্রকৃত সংখ্যা এখনো বের করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) স্টুডেন্ট অ্যান্ড লেবার উইং বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ইস্যুকৃত লাইসেন্সের একটি ডেটাবেজ রক্ষণাবেক্ষণ করে।

যোগাযোগ করা হলে এসবির স্টুডেন্ট অ্যান্ড লেবার উইংয়ের স্পেশাল সুপারিনটেনডেন্ট সাঈদ রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ডেটাবেজ অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে প্রায় আট হাজার ৫০০ আগ্নেয়াস্ত্র ইস্যু করা হয়েছে। তিনি অবশ্য বলেন, সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারে এবং তারা প্রকৃত সংখ্যা বের করতে কাজ করছেন।

পুলিশ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনকে দমন করতে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণে সরকারদলীয় বিবেচনায় দেওয়া সব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে। নির্দিষ্ট সময়সীমা পার হওয়ার পরও যারা তাদের লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা দেননি, তাদের অস্ত্র অবৈধ বলে গণ্য হয়।

বাতিল হওয়া ৭৭৮টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারে নিষ্ক্রিয়তা সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে (২৫ আগস্ট) জমা না দেওয়ায় গত ১ থেকে ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশে দেওয়া ৭৭৮টি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) এসব অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করেছেন। অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালীরা রয়েছেন।

অপরদিকে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যারা আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিয়েছেন, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সেসব অস্ত্র ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যেসব অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে ব্যবহার করার আশঙ্কা রয়েছে, সেসব ফেরত দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে। যারা ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত বা মামলা চলমান, তারাও অস্ত্র ফেরত পাবেন না। একই সঙ্গে বাতিল হয়ে যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও অস্ত্রের মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে এসব বিষয়ে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

সারা দেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা কত অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে বাতিল হওয়ার পর বর্তমানে সারা দেশে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা ৪৪ হাজার ১০৪। এসবের মধ্যে ব্যক্তির নামে রয়েছে ৪০ হাজার ৭৭৭টি। আর বাকি অস্ত্রগুলোর লাইসেন্স করা রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে। এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে একনলা ও দোনলা বন্দুক, শটগান, পিস্তল, রিভলবার ও রাইফেল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বৈধ থেকে অবৈধ হওয়া অস্ত্র উদ্ধার যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সব ধরনের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির পরবর্তী সভায় বিষয়টি তুলে ধরবেন বলে জানান তিনি।

আরবি/জেডআর

Link copied!