ঢাকা রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪
ডেঙ্গু ভয়ংকর

মৌসুম পাল্টে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে

উৎপল দাশগুপ্ত

প্রকাশিত: নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ০১:২৭ এএম

মৌসুম পাল্টে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। চলতি মাসের মাঝামাঝি থেকেই তাপমাত্রা তুলনামূলক কম, সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরও কমে আসবে এমনই আবহাওয়ার পূর্বাভাস। অন্যদিকে শীতকালে সংক্রমণ কমে আসে এমন ধারণা থাকলেও ডেঙ্গু মৌসুম পাল্টে যাওয়ায় তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গতকাল শনিবারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের দিনের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। এতে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪৮। একই দিন ডেঙ্গু নিয়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আরও ৮৮৬ জন, যা আগের দিনের প্রায় দ্বিগুণ।

দৈনিক রূপালী বাংলাদেশের কাছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড হেলথ প্রমোশন ইউনিটের সমন্বয়ক ও রোগতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবির জানিয়েছিলেন, চলতি মাসে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও আক্রান্তের হার বেড়ে যাবে। 
তিনি আরও জানান, আগে ‘জুলাই থেকে অক্টোবর’ ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হলেও চলতি বছর তা পরিবর্তিত হয়েছে ‘অক্টোবর থেকে জানুয়ারি’। অর্থাৎ, এই বিশেষজ্ঞের মন্তব্য অনুযায়ী সামনের ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসও ডেঙ্গু নিয়ে ভুগতে হবে মানুষকে।

ডেঙ্গু নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনায়ও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১৮ হাজার ৯৭ জন। অক্টোবরে দ্বিগুণের চেয়ে কিছুটা কম, অর্থাৎ ৩০ হাজার ৮৭৯ জন আক্রান্ত হয়েছে ডেঙ্গুতে। আর গতকালসহ নভেম্বরের ২৩ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ২৩ হাজার ৮৯৫ জন। মাস শেষ হতে এখনো বাকি এক সপ্তাহ।

অন্যদিকে একই সময়ে মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরে মারা গেছে ৮৭ জন, অক্টোবরে ১৩৬ জন আর চলতি মাসের ২৩ দিনে মারা গেছে ১৩৩ জন। এখনো বাকি রয়েছে এক সপ্তাহ। অর্থাৎ, আক্রান্ত ও মৃত্যু উভয় সূচকই বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে চলতি মাসে।

জলবায়ুর পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ ও মশক নিধনে যথাযথ পদক্ষেপের অভাব ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার কারণ বলে উল্লেখ করেছিলেন অধ্যাপক ডা. ইকবাল কবির।

তার মতে, রোগটি প্রতিরোধের জন্য তিনটি কাজ করা অত্যন্ত জরুরি এক. রোগটি যাতে না হয়, সে জন্য মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করা; দুই. ‘কেইস বেইজড সার্ভিলেন্স’ অর্থাৎ, প্রত্যেক আক্রান্ত ব্যক্তির তথ্য অবহিত হয়ে ওই এলাকায় নজরদারি এবং তিন. করোনার সময়ের মতো রোগীকে ‘আইসোলেশনে’ রাখা, যাতে কোনো মশা আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড় না দিতে পারে। কিন্তু এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় ডেঙ্গুতে ক্রমবর্ধমানভাবে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই।

অন্যদিকে জলবায়ু উষ্ণায়নের কারণে আগামী ২৫ বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ এশিয়া ও আমেরিকায় দ্বিগুণ হতে পারে বলে এক গবেষণা প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ‘ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসি’ গবেষকেরা।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ১৯ শতাংশ ডেঙ্গু হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে ঘটা বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ২০৫০ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ গড়ে বাড়বে ৬১ শতাংশ। কয়েকটি শীতপ্রধান অঞ্চলে এই প্রকোপ বাড়বে দ্বিগুণেরও বেশি।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. এরিন মরডেকাই জানিয়েছেন, এশিয়া ও আমেরিকার ২১টি দেশের ডেঙ্গুর প্রকোপ ও জলবায়ুর ওঠানামার নানা তথ্য তারা খতিয়ে দেখেছেন এবং সেখানে ক্রমাগত তাপমাত্রা ও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার মধ্যে স্পষ্ট ও সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে দেখতে পাওয়া গেছে।

বৃষ্টিপাতের ধরন, ঋতু পরিবর্তন, ভাইরাসের ধরন, অর্থনৈতিক সমস্যা ও জনসংখ্যার ঘনত্ব ডেঙ্গু সংক্রমণের হারকে প্রভাবিত করতে পারে বলে গবেষণায় দেখা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গতকালের মৃতদের মধ্যে ঢাকা জেলায় চারজন (সিটি করপোরেশনের বাইরে), তিনজন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের, একজন উত্তর সিটি করপোরেশনের, একজন চট্টগ্রামের এবং একজন বরিশাল বিভাগের।

হাসপাতালে নতুন ভর্তিদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৪৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৯, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২১, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২০৬, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ১৬৭ ও খুলনা বিভাগে ১০৭ জন। এ ছাড়া রাজশাহী বিভাগে ৪০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৭, রংপুর বিভাগে চারজন এবং সিলেট বিভাগে একজন নতুন রোগী ভর্তি হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৮৫ হাজার ৭১২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৬৩ দশমিক ২০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৮০ শতাংশ নারী। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪৪৮ জনের। এর মধ্যে নারী ৫১ দশমিক ১০ শতাংশ এবং পুরুষ ৪৮ দশমিক ৯০ শতাংশ।

প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গত বছর দেশে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে ঢাকায় ১ লাখ ১০ হাজার ৮ এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন।

আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। গত বছর ১ হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছে, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয় ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যায়।

আরবি/জেডআর

Link copied!