ঢাকা রবিবার, ০৩ নভেম্বর, ২০২৪

ব্যবসা হারাচ্ছে সাত ব্যাংক

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: নভেম্বর ৩, ২০২৪, ১২:২৬ এএম

ব্যবসা হারাচ্ছে সাত ব্যাংক

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

আমানতকারীর টাকায় ব্যবসা করে দেশের ব্যাংকগুলো। সেই টাকায় ঋণদান, ঋণ নবায়ন ও বন্ডসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে মুনাফা তোলে। বিনিয়োগের নির্দিষ্ট প্রান্তিকের আয়ে কর পরিশোধ ও পরিচালন ব্যয় বাদে ব্যবসায়ের মুনাফা অংশীজনের মাঝে বণ্টন করা হয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়ে অধিকাংশ ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে।

ব্যাংকগুলোর মধ্যে শুদ্ধাচারের ঘাটতির কারণে ছয়টি ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান, নবায়ন বা বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করেন গভর্নর। অন্যদিকে প্রবল তারল্য সংকটের কারণে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংকের অবস্থাও শোচনীয়। ফলে ব্যাংকগুলোর আগামী সময় আরও সংকটময় হয়ে উঠছে।

ইতিমধ্যে পুনর্গঠিত ব্যাংক পরিচালক ও তারল্যের সাময়িক সমাধান (ধার) মিললেও ব্যবসার পরিধি বাড়ানো বা এ-সংক্রান্ত পরিকল্পনা করতে পারেনি ব্যাংকগুলো। ফলে ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যাংক খাত ঘুরে দাঁড়াতে আমানতকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয়েও বলেন তারা।

বেসরকারি ১১টি ব্যাংকের মালিকানা পুনরুদ্ধার করেছেন সাবেক উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠিত হলেও ব্যাংকগুলোর ব্যবসায় কোনো গতি নেই। তাদের মধ্যে ছয়টি ব্যাংকের নতুন ঋণ প্রদান, নবায়ন বা বন্ডের মাধ্যমে বিনিয়োগও নিষিদ্ধ। 

পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব ব্যাংক নতুন করে ঋণ বিতরণ বা আগের ঋণ নবায়নও করতে পারবে না। ব্যাংকগুলো হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক।

রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ ক্লিনিক্যালি ডেথ বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার পলিসি ফর ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিহীনতার ফল এটি। এখন আরও ভয়াবহ আশঙ্কার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সহায়তা দিয়ে টেকানোর চেষ্টা করছে, তবে আগামীতে কী হবে তা বলা মুশকিল।

সবল ব্যাংকগুলো থেকে দুর্বল ব্যাংকের টাকা ধার সম্পর্কে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (বিএবি) চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার বলেন, তারল্য সংকট সব ব্যাংকে নয়, কিছু ব্যাংক সমস্যায় আছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ব্যাংকের অনুমোদন হয়েছিল সেসব ব্যাংকে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। বোর্ডের অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ঋণ দেওয়া হয়েছে। আসলে ‘অলিগার্ক’রা ব্যাংক ধ্বংস করে দিয়েছে।

ঘুরে দাঁড়ানো সম্পর্কে তিনি বলেন, আমানত নিয়ে আসার জন্যও চেষ্টাও করা হচ্ছে। কারণ দুর্নীতির কারণে এসব ব্যাংকে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, না হলে আমানত আসবে না। আমানত আসলে ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াবে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি নিয়ে সবল পাঁচটি ব্যাংক দুর্বল ছয়টি ব্যাংককে গত এক মাসে ৪ হাজার ১৬০ কোটি টাকা ধার দেয়। যদিও ধারের অধিকাংশ অর্থই যাচ্ছে আমানতকরীদের অর্থ ফেরত দিতে। কিন্তু দুর্বল ব্যাংকগুলো ঋণদানের ব্যর্থতায় তাদের ব্যবসার পরিধি বাড়াতে পারছে না।

অন্যদিকে ঋণের অর্ধেকের বেশি খেলাপি থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছে। ঋণাত্মক অবস্থানে থাকা আইসিবি ইসলামী ব্যাংক আরও ঘনীভূত সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা ব্যাংক এবং ইউসিবি ব্যাংকের অবস্থাও ভালো নয়। যদিও এরই মধ্যে সবল ব্যাংকগুলোতে তারল্যের পরিমাণ অনেক বেড়েছে।

আওয়ামী সরকারের সহায়তাপুষ্ট চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল বেসরকারি সাতটি ব্যাংক। ব্যাংকগুলো থেকে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা নামে-বেনামে সরিয়েছে গ্রুপটি। যার কারণে গ্রুপের শীর্ষ কর্ণধার সাইফুল আলমসহ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। তাদের সম্পদ বিক্রি করে দায় মেটানোর ঘোষণা দেওয়া হলেও এখনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

প্রবল জনরোষে ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরই ব্যাংকগুলোতে নেতৃত্বের পরিবর্তন দাবিতে ঢাল হয়ে দাঁড়ান পুরোনো কর্মীরা। তারই অংশ হিসেবে তীব্র তারল্য সংকটে ভোগা ছয় ব্যাংকের ঋণ বিতরণে বিধিনিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ঋণ জালিয়াতি ও নানা অনিয়োমের কারণে দুর্বল হয়ে পড়া ব্যাংকগুলোকে তারল্য গ্যারান্টি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিচালক পুনর্গঠিত হওয়া ছয়টি ব্যাংক গত এক মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টি পেয়েছে ৪,১৬০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটিড পেয়েছে ১,৪৯৫ কোটি টাকা; সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পেয়েছে ১,০০০ কোটি টাকা; গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ২৯৫ কোটি; ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ৭৭৫ কোটি; ইউনিয়ন ব্যাংক ১৫০ কোটি এবং ন্যাশনাল ব্যাংক পেয়েছে ৮২০ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোকে তারল্য সুবিধা দিয়েছে সোনালী ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক।

ব্যাংকাররা জানান, আন্তঃব্যাংক থেকে ধারের টাকা পাওয়ায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর প্রতি গ্রাহকের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। অনেক গ্রাহক ব্যাংকগুলোতে আমানতের টাকা তুলতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। যদিও এখনো গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী, আমানতের টাকা ফেরত দিতে পারছে না অনেক ব্যাংকই।

বিভিন্ন আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে যেসব ব্যাংক দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের সংকট কাটাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে তহবিল সংগ্রহ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্যারান্টি সাপেক্ষে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ভালো ১০টি ব্যাংক ধার সহায়তা দিতে রাজি হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরে সঙ্গে এক বৈঠকে সম্প্রতি এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা (এমডি) তাদের তারল্য সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করেন।

গভর্নর আহসান মনসুর এসব ব্যাংকের গ্রাহকরা যাতে টাকা তুলতে ও লেনদেন করতে পারেন সেজন্য আন্তঃব্যাংক থেকে টাকা ধার নেওয়ার নির্দেশনা দেন। এজন্য যেসব ব্যাংক টাকা ধার দেবে তাদের গ্যারান্টি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।

আরবি/জেডআর

Link copied!