ঢাকা সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪
রিফাত হত্যা মামলা

শম্ভুর কুটচালে সাক্ষী থেকে আসামি মিন্নী

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২৪, ১২:৪৪ এএম

শম্ভুর কুটচালে সাক্ষী থেকে আসামি মিন্নী

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

দিনের বেলায় কলেজের গেটের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে রিফাত শরীফ হত্যার আলোচিত ঘটনার ফের গুঞ্জন শুরু হয়েছে বরগুনায়।

বরগুনা-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর গ্রেপ্তারের পর আবারও সামনে এসেছে রিফাত শরীফ হত্যা।

অনেকে মনে করছেন, শম্ভুকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসবে রিফাত হত্যার মূল কাহিনি। ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর একমাত্র ছেলে সুনাম দেবনাথের সঙ্গে তার বাহিনীর দুই গ্রুপের সংঘাতের জেরে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মূল কাহিনি দাবি করে, রিফাত হত্যায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আয়শা সিদ্দিকা মিন্নীর বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর।

তার অভিযোগ বরগুনার মাদকসম্রাট এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ ও সাবেক এমপি শম্ভুর নগ্ন হস্তক্ষেপে রিফাত হত্যার প্রধান সাক্ষী মিন্নীকে আসামি করে মামলাটি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা হয়েছে। মামলার বিচারক ছিল শম্ভুর ঘনিষ্ঠ। তার ইচ্ছা অনুযায়ী রায় প্রদান করা হয়। এ ঘটনায় সুনাম দেবনাথের সম্পৃক্ততা থাকার সম্ভাবনা ছিল বলেই মামলার বাদীকে প্রলোভন দেখিয়ে মিন্নীকে আসামি করে মামলাটি ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করা হয়।

মিন্নীর বাবা মোজাম্মেল হক কিশোর বলেন,  রিফাত শরীফকে কুপিয়ে আহত করার সময় তার মেয়ে মিন্নী আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তাকে বাঁচানোর। মিন্নী রিকশাযোগে বরগুনা হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করেন।

এরপর তিনি তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় বরিশালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। বরিশালে নেওয়ার আগে রিফাত শরীফ তার বাবা দুলাল শরীফের কাছে বলেনÑ‘মিন্নী তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, হাসপাতালে ভর্তি করেছে ওকে যেন মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়।’

পরবর্তী সময়ে এ ঘটনায় সুনাম দেবনাথের নাম উঠে এলে অজ্ঞাত কারণে মিন্নীকে প্রধান সাক্ষী থেকে মামলার ৭ নম্বর আসামি করা হয় শম্ভুর ইঙ্গিতে। মামলার বাদীকে নানাভাবে প্রলোভিত করে তাকে বরগুনা প্রেস ক্লাবে পাঠিয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। পরদিন এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথ মিন্নীকে গ্রেপ্তার করতে মানববন্ধন করা হয়। এই মামলার সব কিছু এমপি শম্ভুর কারিকুলামে করা হয়েছে। মামলার রায় প্রদানকারী বিচারক আসাদুজ্জামান শম্ভুর যোগাযোগ মতে রায় প্রদান করেন। 

তিনি আরো বলেন, ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুনের পরদিন ২৭ জুন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে অজ্ঞাতনামা আরও চার-পাঁচজনকে আসামি করা হয়।

এই অজ্ঞাতনামাদের মাঝেও কি মিন্নী ছিল? এমনটি হলে সেদিন আব্দুল হালিম শরীফ মিন্নীকে এ মামলার প্রধান সাক্ষী রাখল কেন? কারণ হিসেবে মিন্নীর বাবা বলেন, তার বেয়াই মামলার বাদী দুলাল শরীফ প্রলোভনে পড়ে আমার মেয়েকে এই মামলার আসামি করেছে। তার বাড়ির সড়কে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল, এমনকি তাকে বুড়িরচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদের জন্য নৌকা প্রতীক এনে দেওয়া হবে এ প্রলোভনও দেওয়া হয়েছিল।

এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের এই হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। ০০৭ বন্ড বাহিনীর প্রধান নয়ন বন্ডের সঙ্গে তার সখ্য নিয়ে কথা ওঠে সর্বত্র। ঘটনা আড়াল করতেই ২ জুলাই নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত হয়। এরপরই সুনাম দেবনাথ মিন্নীর পিছু নেয়। মিন্নীর দুর্নাম রটাতে রীতিমতো মাঠে নেমে পড়ে সুনাম।

এমপিপুত্রের চাপেই রিফাতের বাবা সংবাদ সম্মেলন করে খুনের নেপথ্যে মিন্নীর সম্পৃক্ততার কথা প্রকাশ্যে আনেন। নিজেকে আড়াল করতে ও খুনিদের বাঁচাতে মিন্নীকে গ্রেপ্তারের দাবিতে বরগুনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। সেখানে এমপিপুত্র তাঁর বক্তব্যে মিন্নীকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। অথচ তিনি তাঁর বক্তব্যে একটিবারও পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার বা গ্রেপ্তারকৃতদের শাস্তি নিয়ে কোনো বক্তব্য দেননি। দেশ তোলপাড় করা এমন ঘটনায় এমপিপুত্রের এমন অবস্থান ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিলেও তিনি ও জড়িতদের বাঁচাতেই মাঠে নেমেছেন এমন মন্তব্য ছিল বরগুনাবাসীর।

এর প্রশ্নের জবাবে মিন্নীর বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, সুনাম দেবনাথ ও তার বাবা শম্ভু পুলিশের তদন্ত ও মানুষের চোখ ভিন্ন দৃষ্টিতে নিতেই তারা এমন ঘটনার জন্ম দেন। এমনকি মিন্নীকে নিয়ে গানও বানানো হয়। তার অনুসারীরা ফেসবুকে নানান গুজব রটাতে থাকেন।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৬ জুন সকালে স্ত্রীকে নিয়ে বরগুনা সরকারি কলেজে যান রিফাত। সেখানে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে রিফাতকে কুপিয়ে আহত করে একদল সন্ত্রাসী।

নয়ন বন্ড নামে এক যুবকের নেতৃত্বে চার-পাঁচ সন্ত্রাসী রিফাতকে দা দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলে যায়। এ সময় বারবার সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নী। ঘটনার পরদিন ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। এজাহারের প্রধান আসামি নয়ন বন্ড পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ২ জুলাই নিহত হন। ওই মামলায় প্রধান সাক্ষী করা হয় আয়শা সিদ্দিকা মিন্নীকে। পরে মিন্নীকে আসামি করে এরপর ১ সেপ্টেম্বর ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে ৬১৪ পৃষ্ঠার চার্জশিট দেয় পুলিশ। এ মামলার ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে রিফাত ফরাজীকে।

গত ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার ১০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। গত ৮ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন আদালত। মোট ৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছিল এই মামলায়। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নীসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক। এ মামলায় ২৪ জনকে আসামি করা হলেও তাদের মধ্যে মিন্নীসহ ১০ আসামি ঘোষণা করা হয়। একই মামলায় বাকি ১৪ আসামি অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের বিচার বরগুনার শিশু আদালতে করা হয়।

আরবি/জেডআর

Link copied!