সোমবার, ৩১ মার্চ, ২০২৫

৬৮০০ কোটি টাকার শেয়ার জব্দ, জানে না বিএসইসি

শাহীনুর ইসলাম শানু

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ১২:৩৭ এএম

৬৮০০ কোটি টাকার শেয়ার জব্দ, জানে না বিএসইসি

ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতে আতঙ্কের নাম সালমান এফ রহমান। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণখেলাপির জনক হিসেবে অনেকেই আখ্যা দিয়ে থাকেন তাকে। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সেই এফ রহমান বর্তমানে কারারুদ্ধ। বিভিন্ন অভিযোগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। তবে শেয়ার জব্দের বিষয়টি জানে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক হিসাব ও পুঁজিবাজারের ২২ হাজার কোটি টাকা জব্দ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। এর মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর পুঁজিবাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা জব্দ করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে কয়েকটি কোম্পানির ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার শেয়ার।

সালমান এফ রহমানের ৪টি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। তা হলোÑ বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, আইএফআইসি ব্যাংক ও বেক্সিকো গ্রিন সুকুক বন্ড। বেক্সিমকো সিনথেটিক বর্তমানে তালিকাচ্যুত হলেও অধিকাংশ বিনিয়োগকারীকে তার বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দেওয়া হয়নি।

বেক্সিমকো লিমিটেড ও বেক্সিমকো ফার্মার পরিশোধিত মূলধনের ৯৩৪ শতাংশই ঋণ হিসেবে ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। বেক্সিমকো লিমিটেড এবং বেক্সিমকো ফার্মার বর্তমান ঋণ ৬ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে, দুই কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ পরিশোধিত মূলধনের ছয় গুণ ঋণ তুলে নিয়েছে কোম্পানি দুটি। এর মধ্যে বেক্সিমকো লিমিটেডের নামে ৫ হাজার ৯৫৭ কোটি এবং বেক্সিমকো ফার্মার নামে ৭৪৬ কোটি টাকা।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি জানায়, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইউ) অনুরোধে এসব শেয়ার জব্দ করার তথ্য প্রকাশ হলেও এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই বিএসইসির কাছে। কতটি কোম্পানির কী পরিমাণ শেয়ার অবরুদ্ধ করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া আরও অন্যান্য কোম্পানির ৭০০ কোটি টাকা মূল্যের শেয়ার জব্দ করা সম্পর্কেও জানে না বিএসইসি।

পুঁজিবাজারে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত সালমান এফ রহমান। ১৯৯৪-৯৫ সালে প্রথম পুঁজিবাজারের ১০ বছর মেয়াদে চারটি ডিবেঞ্চার তালিকাভুক্ত করেন। ডিবেঞ্চারের মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকা উত্তোলন করেও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়নি। এরপরে তিনি আলোচনায় আসেন জিএমজি এয়ারলাইনস নিয়ে। বাংলার আকাশে বিমান উড়াল দিলে আশায় বুক বেঁধে ৩শ কোটি টাকার প্লেসমেন্ট শেয়ার কেনেন বিনিয়োগকারীরা। পরে সেই বিমান কেলেঙ্কারিতে তার কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) আটকা পড়ে। তবে দীর্ঘ সময়েও সেই টাকা বিনিয়োগকারীদের ফেরত দেয়নি। এ নিয়ে মামলা হলে আদালতে গিয়েও সুরাহ মেলেনি।

শেয়ার অবরুদ্ধ করা ৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার শেয়ার সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ও পরিচালক মো. রেজাউল করিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিষয়টি গণমাধ্যমে জেনেছি। তবে কয়টি কোম্পানির, মূল্যমান এবং কী পরিমাণ শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়ছে, সে বিষয়ে জানে না বিএসইসি। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকর্তা হিসেবে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ বিষয়ে ভালো তথ্য দিতে পারবে সিডিবিএল। যদিও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিএসইর তথ্য সংরক্ষণে থাকার কথা’ বলেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে শেয়ার চাইলে দেশের উভয় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংরক্ষণকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) একাধিক কর্মকর্তাও জানেন না বলে জানান।

কর্মকর্তাদের একজন রূপালী বাংলাদেশ বলেন, ‘কমিশন থেকে কোনো নির্দেশনা আসেনি। আমরাও তথ্যটি গণমাধ্যম থেকে জেনেছি।’
দেশ ছেড়ে যাওয়া শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের হাতে আটক হন সালমান এফ রহমান।

এরপর গাজীপুরের বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অস্থিরতা শুরু হয়। অন্তর্বর্তী সরকার তার অবর্তমানে বেক্সিমকোর অচলাবস্থা শুরু হলে গ্রুপে ৮টি কোম্পানি বিক্রির কথা ভাবছে। অন্যদিকে বকেয়া বেতনের দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ শুরু হলে জানুয়ারি পর্যন্ত ১৮০ কোটি টাকা নতুন ঋণ হিসেবে বেতনের সিদ্ধান্ত জানায় সরকারের জনতা ব্যাংক। 

এদিকে বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে মোট ৩২টি ফ্যাক্টরি রয়েছে। তার মধ্যে ১৬টির কোনো অস্তিত্ব নেই বলে জানিয়েছেন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন।

সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে মোট ৩২টি ফ্যাক্টরির মধ্যে ১৬টির কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু এই ১৬ কোম্পানির বিপরীতে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। ১২টি ফ্যাক্টরি ম্যানেজমেন্ট থেকে লে-অফ করা হয়েছে, যা সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। তিনটি ফ্যাক্টরি বর্তমানে চলমান জানিয়ে তিনি বলেন, বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে অবস্থিত ৩২টি ফ্যাক্টরির বিপরীতে ২৯ হাজার ৯২৫ কোটি টাকাসহ বেক্সিমকো লিমিটেডের মোট ব্যাংকঋণ বর্তমানে ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে শুধু জনতা ব্যাংকের পাওনা ২৩ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা।

সর্বশেষ চলতি বছরে পুঁজিবাজার থেকে আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা নেওয়ার চেষ্টা করেন সালামান এফ রহমান। প্রবল জনস্রোতের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলে তার সব চেষ্টাই বিফলে যায়।

আরবি/জেডআর

Link copied!