ঢাকা: হাজারো ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে আওয়ামী সরকারের পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার গঠন করা সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই এবার বিচারের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন তিনি। এটিকে নিয়তির পরিহাস বলছেন সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা। আগামী ১ নভেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে হত্যা-গণহত্যার ঘটনায় দায়ের করা ৫৯ মামলার বিচারকাজ।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল গতকাল মঙ্গলবার হাইকোর্টে ট্রাইব্যুনালের সংস্কারকাজ পরিদর্শনে গিয়ে এ তথ্য জানান। যদিও এর আগে দুপুরে বিচারপতিদের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হবে বিচারকাজ। আজ ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে দেওয়া হবে বিচারপতিদের সংবর্ধনা।
লোক দেখানো নির্বাচনে সারে ১৫ বছর দায়িত্বে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ’৭১-এ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। একে একে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ও বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের অনেক নেতাকে এই ট্রাইব্যুনালে বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো অনেকেই যুদ্ধাপরাধী না হওয়া সত্ত্বেও তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। যথেষ্ট স্বাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকার পরও তাদের একতরফা দোষী সাব্যস্ত করা হয়। সরকারের হীন চেষ্টায় তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন বলে সে সময় অভিযোগ উত্থাপিত হয় আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকেও।
গত সোমবার বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারকে প্রধান করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। বিষয়টির অনুমোদন দিয়েছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। শিগগিরই এ আইনে দায়ের হওয়া মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এর প্রয়োজন হলে সরকার তা করতে প্রস্তুত রয়েছে বলে জানান আইন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। আজ বুধবার পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিচারপতিদের ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে দেওয়া হবে সংবর্ধনা।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যত মামলা : আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার ৫৯টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও দুটি মামলা আছে, যাতে তার নাম নেই। কয়েকটিতে আওয়ামী লীগের নেতা এবং হাসিনার আমলের মন্ত্রীদের নামও উল্লেখ রয়েছে। গত ৫ আগস্ট সাভারে গুলিবিদ্ধ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী আলিফ আহমেদ সিয়াম চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই দিন পর (৭ আগস্ট) মৃত্যুবরণ করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। এ ছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ১৭০টি হত্যাসহ মোট ১৯১টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই মামলাগুলোর বিচারও দ্রুত শুরু করতে চাইছে সরকার।
এই ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মহম্মদ তাজুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে জানান, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট ৫৯টি মামলার অভিযোগ এসেছে। এর সবগুলোতেই শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। দুটিতে তার নাম নেই। তিনি জানান, আইনের বিধান অনুযায়ী তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন পর্যালোচনা করে যাদের মূল আসামি বলে মনে হবে, তাদের নাম ট্রাইব্যুনালে পেশ করা হবে। বাদীপক্ষ যেটা নিয়ে এসেছে, পর্যালোচনা করে তার সঙ্গে নাম সংযোজন বা বিয়োজন হতে পারে বলেও জানান তিনি।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর যেটা দাখিল করা হবে, সেটাই ‘প্রপার মামলা’ হবে বলে জানান তাজুল ইসলাম।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন : ২০০৯ সালে সংসদ অধিবেশনে ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার’ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের একটি মৌখিক প্রস্তাব পাস হয়। পরবর্তী সময়ে ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকেও বিচারের আওতায় আনা এবং স্বাধীনভাবে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ পরিচালনার বিধান যুক্ত করে আইনে কিছু সংশোধনী আনা হয়। এর মাধ্যমেই ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। তবে ২০১০ সালের আগে আইনে কারও বিচার বা সাজা হয়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে যা আছে : ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের ৩(১) ধারায় বলা আছে, আইনের দুই নম্বর উপধারায় উল্লিখিত যেকোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংস্থা বা কোনো সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, তা যদি এই আইন প্রবর্তনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে-সংঘটিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে। অর্থাৎ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, শান্তিবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশনবিরোধী কাজসহ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনো অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা দল, সেনাবাহিনী কিংবা তাদের সহযোগী সশস্ত্র বাহিনীর বিচারের ক্ষমতা ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হয়েছে।
বিচার শুরু হওয়া নিয়ে আইন উপদেষ্টার বক্তব্য : মঙ্গলবার পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে ট্রাইব্যুনালের সংস্কারকাজ পরিদর্শনে গিয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘আগামী ১ নভেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে হত্যা-গণহত্যার ঘটনার বিচার করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কারকাজ দ্রুতগতিতে চলছে। আশা করছি, আগামী ১ নভেম্বর থেকে মূল ভবনে বিচারকাজ পরিচালনা করা যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের পর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের আসামি করার বিষয়ে প্রসিকিউশন টিম পদক্ষেপ নেবে। এতটুকু বলতে পারি, দোষী সাংবাদিকদেরও বিচার হবে। তবে সেটা সুবিচার।’
চিফ প্রসিকিউটর যা বললেন : গতকাল বিচারপতিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আগামী বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারকাজ। তাজুল ইসলাম বলেন, আজ (বুধবার) ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে বিচারপতিদের সংবর্ধনা দেওয়া হবে। এরপর বৃহস্পতিবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ এজলাসে বসবেন। সেদিন থেকে শুরু হবে বিচারকাজ।
পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে নিয়োগের পর গতকাল প্রথম কর্মদিবসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসেন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার, দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তারা ট্রাইব্যুনালে আসেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ও অন্যান্য কর্মকর্তা তাদের অভ্যর্থনা জানান।
আপনার মতামত লিখুন :