যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আজ। বিশ্বজুড়ে নজর এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। কে বসবেন হোয়াইট হাউসে। আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নীতিসহ বিশ্বরাজনীতির মেরূকরণে কে করবে প্রভাব বিস্তার এই নিয়ে বিশ্ববাসীর নজরও এখন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। নির্বাচনের ফল বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব ফেলবে। শুধু বিশ্ববাসী নন, বিশ্বনেতারাও এ নির্বাচন নিয়ে বেশ তৎপর। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত পোল রিপোর্ট অনুযায়ী, একে অপরের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস।
আলোচনায় আছেন আরও চার প্রার্থী। লড়ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৬ নেতা। খবর আলজাজিরা, ইকোনমিক টাইমস, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, এবিসি নিউজ, এএফপি।
ইতোমধ্যে আগাম ভোট দিয়েছেন সাত কোটি ৭০ লাখের বেশি ভোটার। গত মঙ্গলবার ভোটগ্রহণ হলেও কবে জানা যাবে ফল তা নিয়ে কৌতূহল রয়েছে অনেকের মাঝে। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয় নির্বাচনি রোডম্যাপ। আজ ৫ তারিখ নির্বাচন হলেও প্রেসিডেন্টের চূড়ান্ত ফলের পরে শপথ গ্রহণের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আগামী বছরের জানুয়ারির ২০ তারিখ পর্যন্ত।
গতকাল সোমবার আলজাজিরার প্রতিবেদন থেকে যে তথ্য জানা যায়, সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ নভেম্বর নাগরিকরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। এই ভোট সরাসরি অথবা ডাকযোগে তারা দিয়ে থাকেন। এরপর ৬ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর সময়ের মধ্যে স্টেটগুলো তাদের ফল প্রকাশ করবে এবং চূড়ান্ত করবে।
আগামী ১৭ ডিসেম্বর ইলেক্টোরাল কলেজ ভোটাররা তাদের অফিসিয়াল ভোট দেওয়ার জন্য মিলিত হবেন এবং কার্যক্রম শুরু করবেন। এরপর আগামী ২০ জানুয়ারি সোমবার নতুন প্রেসিডেন্টের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
জানা গেছে, বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রগুলো রাজ্য ও কাউন্টির ওপর নির্ভর করে সন্ধ্যা ৬টা থেকে মধ্যরাতের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। সাধারণ নিয়ম হলো যে, আপনি যত পশ্চিমে যাবেন, সময় অঞ্চলের পার্থক্যের কারণে দেরিতে ভোট বন্ধ হয়ে যাবে। সময়ের ব্যবধানের কারণে এমনো হতে দেখা যায়, পূর্বাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা শুরু হয়ে যায়, কিন্তু আলাস্কা ও হাওয়াইয়ের মতো অঙ্গরাজ্যের ভোটাররা তখনো ভোট দিতে থাকেন। ভোট শেষ হওয়ার পরে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা থেকে গণনা শুরু হবে। নির্বাচনের সম্ভাব্য বিজয়ী কে, তা জানতে হয়তো কয়েকদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে না। ২০১৬ সালে অবশ্য ভোটের পরদিন সকালেই ট্রাম্পকে বিজয়ী হিসেবে স্বীকার করে নেন হিলারি ক্লিনটন। তবে অনেক সময় ফল জানতে কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হয়। যেমন- ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর ভোটগ্রহণের চার দিন পরে জো বাইডেনকে বিজয়ী বলা সম্ভব হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল নির্ধারণী সাত রাজ্য অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, উত্তর ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনের ফলের জন্য পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ভোট গণনায় অতিরিক্ত সময়ের দরকার হয়েছিল ওই সময়। এ ছাড়া ডাকযোগে দেওয়া ভোট গণনা করার জন্য নির্বাচনের ফল জানতে আরও তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৮৯ সাল থেকে ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা ছাড়া চার বছর অন্তর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়েছে। তবে কোনো নারী এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে জিততে পারেননি। ৫৯ বছর বয়সী কমলা হ্যারিস জয়ী হলেই ২৩৫ বছরের গণতান্ত্রিক চর্চার ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে কৃতিত্বের অধিকারী হবেন। যা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বলতম উদাহরণ। অন্যদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি নির্বাচনে জয়ী হন তবে তিনি গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পর দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হতে হবেন। যিনি মেয়াদ শেষে নির্বাচনে হেরে গিয়ে চার বছর পর ফের জয়ী হয়েছিলেন। ১৮৯৩ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন গ্রোভার। ১৩১ বছরের আগেকার সেই অনবদ্য রেকর্ড ভাঙার সুযোগ হাতছানি দিচ্ছে রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিকল্প কে? এ দুজনের বাইরে আলোচনায় আছেন আরও চার প্রার্থী। তারা হলেন- বামপন্থি জিল স্টেইন, কর্নেল ওয়েস্ট, চেজ অলিভার ও রবার্ট জুনিয়র কেনেডি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এ নির্বাচন দোদুল্যমান ৭টি অঙ্গরাজ্যের ভোটের ফলের ওপরই নির্ভর করবে কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়-পরাজয়। এরই মধ্যে ৮ কোটির বেশি আগাম ভোট পড়েছে। ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ৪৩টি রাজ্যই ডেমোক্র্যাটিক ব্লু কিংবা রিপাবলিকান রেড স্টেট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
দোদুল্যমান ৭টি অঙ্গরাজ্য হলো অ্যারিজোনা, নেভাদা, উইসকনসিন, মিশিগান, জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলাইনা ও পেনসিলভানিয়া।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর গাজা যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের নীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। ইরানকে নিয়ে ট্রাম্প ও কমলার দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই আলাদা। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা মনে করেন, মার্কিন নেতৃত্বে যিনিই আসুন, তাকে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত মুসলিম বিশ্ব। এ নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তায় পড়তে হতে পারে নতুন প্রেসিডেন্টকে।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক গত চার বছরে অনেকটা দৃঢ় হয়েছে বটে, তবে সমঝোতার ক্ষেত্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে অগ্রগতির পরিমাণ আশানুরূপ নয়। নতুন প্রশাসনকে এই দিকে মনোযোগ দিতে হবে, সেইসঙ্গে সামরিক সহযোগিতা বাড়ানোরও উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। দক্ষিণ এশিয়াকে স্থিতিশীল করতে দুই দেশের সরকারকেই বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে বলেও মনে করেন তারা। অবশ্য কদিন আগেই ট্রাম্প স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তার পরম বন্ধু নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৃহত্তর অংশীদারি আরও জোরদার করবেন; যা প্রভাব ফেলতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে লড়ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৬ নেতা: যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনে লড়ছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৬ নেতা। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ছয় প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজন এরই মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং তারা পুনরায় নির্বাচনের জন্য দাঁড়িয়েছেন। এই প্রার্থীরা বাংলাদেশি-আমেরিকান সমাজে বেশ উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। জর্জিয়া স্টেট সিনেটর শেখ রহমান এই প্রার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন। জর্জিয়ার সিনেট ডিস্ট্রিক্ট ৫ থেকে শেখ রহমান পুনরায় নির্বাচনে লড়ছেন।
ট্রাম্প-কমলা ছাড়াও আলোচনায় আরও চার প্রার্থী: স্মরণকালের মধ্যে এবার দেশটিতে সবচেয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ভোট হচ্ছে এবার। আলোচনায় আছেন আরও চার প্রার্থী। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে এই চারজনও প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারেন। গ্রিন পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ৭৪ বছর বয়সী জিল স্টেইন এর আগে ২০১২ ও ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছিলেন। ওই সময় তিনি দশমিক ৪ শতাংশ ও ১ শতাংশ করে ভোট পেয়েছিলেন। শিকাগো শহরে জন্ম নেওয়া ৭৪ বছর বয়সী চিকিৎসক ও পরিবেশকর্মী জিল স্টেইন এবার ৪০টি অঙ্গরাজ্যে লড়ছেন। তাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা ডেমোক্র্যাট শিবিরে। গ্রিন পার্টি থেকে জিল স্টেইন ছাড়াও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করছেন কর্নেল ওয়েস্ট। বর্ণবাদবিরোধী ৭১ বছর বয়সী এ শিক্ষাবিদ বাইডেনকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ ও ট্রাম্পকে ‘নব্য ফ্যাসিস্ট’ বলে মনে করেন। তিনি ১২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে লড়ছেন। তার সমর্থন অল্প হলেও ডেমোক্র্যাট শিবিরের জন্য তিনি বড় দুশ্চিন্তার নাম। লিবার্টারিয়ান পার্টি ২০২০ সালের নির্বাচনে ১ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পেয়েছিল।
স্টেটগুলোতে ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসের চেয়ে ১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটে এগিয়ে রয়েছেন ট্রাম্প।
মার্কিন নির্বাচনের আগে ভোটার জালিয়াতির নজিরবিহীন অভিযোগ: মার্কিন নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বিভ্রান্তিকর সব অভিযোগ এবং ভোটার ও ভোট জালিয়াতি নিয়ে মিথ্যা তথ্য অনলাইনে নজিরবিহীন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে। কথিত এই অনিয়মের অভিযোগের ঘটনাগুলো ছড়াচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তিসহ স্বতন্ত্র ও রিপাবলিকান-সমর্থক গোষ্ঠীগুলো। তবে ডেমোক্র্যাটদের কাছ থেকেও অল্পসংখ্যক পোস্ট আসছে।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া জালিয়াতি, অনিয়মের অভিযোগের এই ঝড় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ মঙ্গলবার ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়ার পাশাপাশি তাদের গুজব মোকাবিলাসহ ভোটারদেরও আশ্বস্ত করতে হচ্ছে। নির্বাচনের ফল তিনি মেনে নেবেন কি না, জানতে চাওয়া হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেপ্টেম্বরের প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কের সময় বলেছিলেন, যদি সুষ্ঠু ও বৈধ এবং ভালো নির্বাচন হয় তাহলে তিনি ফল মেনে নেবেন। সোমবার প্রকাশিত সিএনএন-এসএসআরএসের জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন, ট্রাম্প পরাজিত হলে ফল প্রত্যাখ্যান করবেন।
আপনার মতামত লিখুন :